রংপুরের পীরগাছার পর মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলাতেও অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের (IEDCR) বিশেষজ্ঞরা এ পর্যন্ত নয়জনের শরীরে সংক্রামক এই রোগ শনাক্ত করেছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, জুলাই ও আগস্ট মাসে পীরগাছা উপজেলায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুইজন মারা গেছেন। একই সময়ে উপজেলার চারটি ইউনিয়নে অন্তত দুই শতাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত হন। পরে অসুস্থ গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে প্রাণিসম্পদ বিভাগ অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করে।
আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন জানিয়েছেন, ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর আইইডিসিআরের একটি প্রতিনিধি দল পীরগাছা সদর এবং পারুল ইউনিয়নের অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ থাকা ১২ জনের নমুনা সংগ্রহ করে; এর মধ্যে আটজনের শরীরে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়। তিনি আরও বলেন, একই সময়ে মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলাতেও সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে। মিঠাপুকুরের চারজনের নমুনা পরীক্ষায় একজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়। কাউনিয়া উপজেলার পাঁচজনের নমুনা সংগ্রহ করা হলেও রিপোর্ট এখনও আসেনি।
রংপুর বিভাগে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি পশু জবাই হয়, কিন্তু এসব পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না। বিভাগে এক হাজার ৩০৩টি হাট-বাজার রয়েছে, তবে কোথাও আধুনিক কসাইখানা বা ভেটেরিনারি সার্জনের উপস্থিতি নেই। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সংরক্ষণ আইনে পশু জবাইয়ের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানা হচ্ছে না। ফলে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস মানুষের শরীরে পৌঁছে যাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
রংপুর জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক আরবিন্দু কুমার মোদক সাংবাদিকদের বলেন, “তিন উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হওয়ায় আমরা সতর্ক রয়েছি। উপজেলাগুলোতে স্বাস্থ্য সহকারীদের নমুনা সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দিয়েছে আইইডিসিআর। আক্রান্তদের খবর পেলে নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরকে পাঠানো হচ্ছে। একই সঙ্গে জনগণকে অ্যানথ্রাক্স বিষয়ে সচেতন করার কাজও চলছে।”
পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত জানিয়েছেন, আক্রান্ত এলাকায় চিকিৎসকরা গিয়েছিলেন এবং রোগীদের সচেতন করা হচ্ছে। আক্রান্তদের অধিকাংশই সুস্থ হয়েছেন। নতুন কোনো সংক্রমণ রোধে কঠোর নজরদারি চলছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড় ও নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। রোগটি গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হয় না। মানুষের শরীরে প্রধান লক্ষণ হলো চামড়ায় ঘা সৃষ্টি হওয়া। তাই চিকিৎসকরা প্রাণিসম্পদ বিভাগকে গরু ও ছাগলের প্রতিষেধক টিকা কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রচলিত আইনে মাংস ব্যবসা শুরুর আগে প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ নিতে হয় এবং এরপর প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে মাংস বিক্রির লাইসেন্স নিতে হয়। তবে রংপুর বিভাগের অধিকাংশ মাংস ব্যবসায়ী এই সনদ রাখেন না এবং নিয়মটি জানেন না।
তারাগঞ্জ উপজেলার মাংস ব্যবসায়ী বক্কর আলী বলেন, “মাংস ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেওয়ার কথা আগে জানতাম না। সম্প্রতি জানতে পেরেছি, এখন নেব। আমরা অসুস্থ পশু জবাই করি না, তাই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করি না।”
রংপুরের ডেপুটি সিভিল সার্জন রুহুল আমিন জানিয়েছেন, “আক্রান্তদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক পর্যাপ্ত আছে। রোগের চিকিৎসা দিতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেহেতু রোগটি প্রাণী থেকে আসে, তাই প্রতিরোধে মূল দায়িত্ব প্রাণিসম্পদ দপ্তরের।”
পীরগাছা সদর, পারুল, ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা দাবি করেছেন, দুই মাসে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে অন্তত এক হাজার গবাদিপশু মারা গেছে।
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ জানিয়েছেন, জেলায় ১৩ লাখের বেশি গরু, ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। ২৬ আগস্ট একটি বেসরকারি টেলিভিশনে অ্যানথ্রাক্স নিয়ে প্রতিবেদন সম্প্রচার হওয়ার পর থেকে রোগ প্রতিরোধে কাজ করছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। এ পর্যন্ত পীরগাছা, কাউনিয়া, মিঠাপুকুর ও রংপুর সদর উপজেলায় এক লাখ ৬৫ হাজার গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ছাগলে আক্রান্তের হার খুব কম, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রাণিসম্পদ বিভাগ মসজিদ, মন্দির, হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
রংপুর বিভাগের প্রাণিসম্পদ দপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক মো. আব্দুর হাই সরকার জানিয়েছেন, “মাংস ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য মাঠপর্যায়ে উদ্বুদ্ধ করছি। নিয়মিত পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা চাইলেও জনবল সংকটের কারণে সব জায়গায় তা সম্ভব হয় না। প্রতিটি হাটে চিকিৎসক পাঠানো সম্ভব নয়, তবে স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে হাট-বাজারে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।”
অ্যানথ্রাক্স কি?
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অ্যানথ্রাক্স হলো ব্যাসিলাস অ্যাথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি প্রাণঘাতি রোগ। এটি প্রথমত গবাদিপশুকে আক্রান্ত করে এবং আক্রান্ত পশুর মাধ্যমে মানুষ সংক্রমিত হয়। এজন্য অ্যানথ্রাক্সকে জুনোটিক ডিজিজ বলা হয়। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হয় না। জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কক ১৮৭৬ সালে এই ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন। ব্যাকটেরিয়াটি দেখতে রডের মতো লম্বাটে এবং গ্রাম-পজেটিভ। ব্যাকটেরিয়া মাটিতে স্পোর তৈরি করে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। অনাবৃষ্টির পর অতিবৃষ্টিতে মাটিসহ ঘাসের মাধ্যমে গবাদিপশুর শরীরে প্রবেশ করে। পশুর শরীরে প্রবেশের পর বিভাজনের মাধ্যমে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়ে মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত পশুর শরীরে স্পোর তৈরি হয় না, তবে মাটিতে এটি ১০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।