সাতচল্লিশ থেকে এখন পর্যন্ত সব ভুলের জন্য জামায়াতের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা: শফিকুর রহমান

জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, শুধু ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য নয়, বরং ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যেকোনো ভুল বা অন্যায়ের জন্য দলটি নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাইছে।

যুক্তরাষ্ট্রে সপ্তাহব্যাপী সফরের প্রথম দিনে, বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি জামায়াতের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেন।

তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেব জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর আমি বলেছিলাম— শুধু একাত্তর নয়, সাতচল্লিশ সাল থেকে শুরু করে যদি জামায়াতে ইসলামী কারো কষ্ট দিয়ে থাকে, কারো ক্ষতি করে থাকে, তাহলে আমি সংগঠনের পক্ষ থেকে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাইছি। সবাই আমাদের ক্ষমা করবেন।”

শফিকুর রহমান স্বীকার করেন, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তৎকালীন জামায়াত নেতৃত্বের ‘সম্মান করা উচিত’ ছিল। কেন তারা তা করেননি, সে বিষয়ে মন্তব্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ সে সময় তিনি দলের নেতৃত্বে ছিলেন না।

মতবিনিময়ের সময় তাকে হাতজোড় করে কথা বলতে দেখা যায়। হাসিমুখে তিনি বলেন, “আমরা মানুষ, ভুল আমাদের হবেই। আমাদের সংগঠনও মানুষের সংগঠন। শত সিদ্ধান্তের মধ্যে একটাও যদি ভুল হয় এবং তাতে জাতির ক্ষতি হয়, তাহলে সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ায় সমস্যা কোথায়? এখন আবার অনেকে বলেন, ‘এই ভাষায় নয়, ওই ভাষায় ক্ষমা চাইতে হবে’। আমি তো বিনা শর্তেই ক্ষমা চাইলাম, তবুও প্রশ্ন রয়ে যায়—আর কীভাবে চাইব?”

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রথম নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় গত ২৭ মে। সেদিন যুদ্ধাপরাধের মামলায় এটিএম আজহারুল ইসলাম খালাস পাওয়ার পর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আমির শফিকুর রহমান বলেছিলেন, “আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই। দল হিসেবে দাবি করি না যে আমরা ভুলমুক্ত। যেখানেই আমাদের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা কষ্ট পেয়েছেন, তাদের সবার কাছে আমরা শর্তহীনভাবে ক্ষমা চাই।”

তবে সে সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে সরাসরি কিছু বলেননি। প্রায় পাঁচ মাস পর নিউ ইয়র্কের অনুষ্ঠানে তিনি বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার অবস্থান জানান।

তার ভাষায়, “একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা ছিল, তা অস্বীকার করছি না। তখন দলটি মনে করেছিল, পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার। তখনও আওয়ামী লীগের বহু নেতা পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করেছেন, বেতন নিয়েছেন, এমনকি তাদের পরিবারের অনেকে রেশন সুবিধাও পেয়েছেন। এগুলো বাস্তবতা, এতে আপত্তি নেই।”

তিনি আরও দাবি করেন, ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকায় পাকিস্তানের পতাকা উড়েছিল। “অফিস-আদালতগুলোতেও পাকিস্তানের নামে কাজ চলত। তবে ১৫ ডিসেম্বর থেকে পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে যায়। দুদিনের মধ্যেই পতাকা নামিয়ে নেওয়া হয়, চাকরিও বন্ধ হয়।”

শফিকুর রহমান বলেন, “জনপ্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। জামায়াত সেটাকে সম্মান করেনি—এটা বৈধ প্রশ্ন। করলে ভালো হতো, করা উচিতও ছিল। তবে আমি সে সময় নেতৃত্বে ছিলাম না, তাই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ বলতে পারব না। আমাদের তৎকালীন নেতারা জীবিত অবস্থায় এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।”

তিনি উল্লেখ করেন, “আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়তো ভুল ছিল। যদিও আমরা অপরাধ করিনি, তারপরও তিনবার ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়েছে—প্রফেসর গোলাম আজম, মাওলানা মতিউর রহমান এবং আমি নিজে।”

শফিকুর বলেন, “আবারও প্রকাশ্যে বলছি, সাতচল্লিশ সাল থেকে ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত যাদের আমরা কষ্ট দিয়েছি, সবাইকে বিনা শর্তে ক্ষমা চাইছি—তা ব্যক্তি হোক বা গোটা জাতি। ভুলের ঊর্ধ্বে আমরা কেউই নই। যারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।”

কোয়ালিশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন (কোবা) আয়োজিত এ মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন জামায়াতের যুক্তরাষ্ট্র সমন্বয়কারী নাকিবুর রহমান। কুইন্সের ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনা পার্টি হলে আয়োজিত সভায় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন জামায়াত আমির।


ভারতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে বক্তব্য

এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা যদি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পাই, বাংলাদেশ হবে বাংলাদেশই। আফগানিস্তান, ইরান, ইন্দোনেশিয়া বা পাকিস্তান নয়। আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে দল-ধর্মের বিভাজন থাকবে না।”

তিনি বলেন, “আমরা এখন মেজরিটি-মাইনোরিটি মানসিকতা থেকে বের হতে চাই। যখনই আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু বলবেন, তখনই দেশ বিভক্ত হবে। আমরা ৫৪ বছর ধরে এর পরিণতি দেখেছি, এবার ঐক্যের পথে হাঁটতে চাই।”

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রতিবেশী বদলানো যায় না। আমরা ভারতকে সম্মান করতে চাই, একইভাবে তাদের কাছ থেকেও সম্মান প্রত্যাশা করি। পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতেই সম্পর্ক গড়ে উঠতে হবে। ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২৬ গুণ বড় দেশ, তাই সমতা নয়—বরং পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্কই টেকসই হবে।”


বিএনপির সঙ্গে বর্তমান টানাপড়েন

১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে, পরে ১৯৯৯ সালে জোটবদ্ধ হয় দুটি দল। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়ে খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন জামায়াতের দুই নেতা—মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।

দুই দশক টিকে থাকা জোট ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ভেঙে যায়। পরবর্তীতে বিএনপি সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনে নামে। দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনের পর গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতন হলে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি আবার উন্মুক্ত হয়।

তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দুই দলের সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা দুটি স্বতন্ত্র দল। জাতীয় প্রয়োজনে একসাথে ছিলাম, এখন ভিন্ন প্রেক্ষাপট। তারা তাদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে, আমরা আমাদের নিয়ে।”

তিনি বলেন, “আমরা কোনো দলকে লক্ষ্য করে কথা বলি না, নীতিগত অবস্থান নিয়েই বলি। গত বছরের আগস্টে সরকারের পতনের পর আমরা সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিছু ভুল পদক্ষেপ না নিলে তারা আরও জনপ্রিয় হতো। তবে এখন আমরা স্বাধীনভাবে নিজের পথেই হাঁটছি।”

তার ভাষায়, “আমরা কোনো দলের সঙ্গে দরবারে বসব না। ভালো কাজের পাশে থাকব, খারাপ কিছু দেখলে আগে পরামর্শ দেব। না শুনলে প্রতিবাদ করব। এটাই আমাদের নীতি। রাজনীতিতে সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা থাকা জরুরি—এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।”

যুক্তরাষ্ট্র সফরে মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা এখনই প্রকাশ করা যাবে না।”

তিনি আরও জানান, আগামী ২৬ অক্টোবর নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের এক সমাবেশে তিনি ভাষণ দেবেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত জামায়াত-অনুসারীরাও অংশ নেবেন।