বদরুদ্দীন উমরকে শেষ বিদায় ফুলেল শ্রদ্ধা ও স্মৃতিচারণে

লেখক, গবেষক ও মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরকে শেষ বিদায় জানানো হলো ফুলেল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে।

সোমবার সকাল ১০টা থেকে বেলা পৌনে ১টা পর্যন্ত তার মরদেহ রাখা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। এ সময় বুদ্ধিজীবী, সরকারের উপদেষ্টা, রাজনীতিকসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রয়াতের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “বদরুদ্দীন উমর অসাধারণ একজন মানুষ; তিনি কখনো আপস করেননি। জ্ঞানী ছিলেন, পণ্ডিত ছিলেন। তার গবেষণা আমাদের পথ দেখিয়েছে। তিনি কখনো হতাশাবাদীও ছিলেন না, সবসময় আশার পথ দেখিয়েছেন। তার কাজের জন্য আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।”

৯৪ বছর বয়সী বদরুদ্দীন উমর রোববার সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান। পরদিন সকাল ১০টায় তার মরদেহ আনা হয় শহীদ মিনারে; এর আগেই অনেকে সেখানে জড়ো হন। পরে সোয়া ১০টা থেকে শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন।

কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার বলেন, “আমাদের আগামী দিনের ইতিহাসের যে বিবর্তন ঘটবে, সেখানে বদরুদ্দীন উমর থাকবেন। আমাদের জাতিবাদী ধারার গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তিনি। তিনি স্রোতে গা ভাসাননি; যা বিশ্বাস করেছেন, তা বলেছেন। সেই বিশ্বাস ছিল মানুষের পক্ষে। এখন বিশ্বব্যাপি শ্রেণি-সংগ্রামের যে লড়াই, তাতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিতে তত্ত্বগত গুরুত্ব অনেক, সেখানে তার ভূমিকা রয়েছে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ বলেন, “রাজনীতির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং সাংগঠনিক চর্চায় বদরুদ্দীন উমরকে পাঠ করতেই হবে। তিনি আজন্ম মানুষের পক্ষে গবেষণা করেছেন, রাজনীতির তত্ত্বগত বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেনও, এমন জীবনই তিনি যাপন করতে চেয়েছেন এবং সে জীবন নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।”

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, “বদরুদ্দীন উমর আমাদের দেশের একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও গবেষক। তার বইগুলো এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার আরেকটি দিক হলো মতাদর্শিক সততা এবং বুদ্ধিজীবীসুলভ সাহস। দেশ যখন সংকটে পড়ে তখন বুদ্ধিজীবীরা পথ দেখান। বদরুদ্দীন উমর ছিলেন সেই আলোকবর্তিকা, যিনি বারবার দেশকে সংকটে পথ দেখিয়েছেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক শাহমান মৈশান বলেন, “এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাস যে অবিচ্ছেদ্য, সেটি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বদরুদ্দীন উমর। তার এই বিশ্লেষণ তরুণদের প্রভাবিত করেছে কয়েক দশক ধরেই। তিনি এই সময়ে যেমন প্রাসঙ্গিক, ভবিষ্যতের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির সঙ্গেও প্রাসঙ্গিক থাকবেন।”

সরকারের শ্রদ্ধা

অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, “একজন আপসহীন মানুষ চলে গেলেন। তিনি নিজের আদর্শে ছিলেন অবিচল। আমাদের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।”

সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “চব্বিশের অভ্যুত্থানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন যে বুদ্ধিজীবী, তিনি বদরুদ্দীন উমর। তিনি ইতিহাসের সত্য লিখেছেন। বদরুদ্দীন উমর সকল পুরস্কারের ঊর্ধ্বে। আমরা তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি জানান তিনি পুরস্কার নেবেন না।”

এছাড়া শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

রাজনীতিকদের শ্রদ্ধা

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, “বদরুদ্দীন উমর সবসময় ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, শোষকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। আমরা অনেক বুদ্ধিজীবীকে বিবেক বন্ধক রাখতে দেখেছি, কিন্তু তিনি মানুষের মুক্তির পক্ষে থেকেছেন।”

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “দুটি কারণে তাকে মনে রাখতে হবে। প্রথমত, তিনি মতাদর্শে অবিচল ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি আজীবন মানুষের পক্ষে থেকেছেন।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “বদরুদ্দীন উমর হাসিনার শাসনকে ফ্যাসিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বাহাত্তরের সংবিধানকে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশকে এমন জায়গায় দাঁড় করাতে হবে, যেন আর কখনো ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া না দিতে পারে।”

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, “বদরুদ্দীন উমরকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি শিক্ষকতা করেছেন, গ্রামে ঘুরেছেন, সংগঠন করেছেন। তার পার্টি বড় না হলেও তার আদর্শ জনগণের স্বার্থের পক্ষে ছিল। মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে তিনি ভবিষ্যতেও প্রেরণা যোগাবেন।”

শ্রদ্ধা নিবেদনকারী দল ও সংগঠনের মধ্যে ছিল— ছাত্র ইউনিয়ন, চিন্তা পাঠচক্র, ভাববৈঠকী, বাংলাদেশ জাসদ, জাতিসত্তা মুক্তি সংগ্রাম, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন (নরসিংদী), প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি), বাংলাদেশ লেখক শিবির, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় কমিটি, জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (টাফ), বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বাংলাদেশ কৃষক ও গ্রামীণ মজদুর ফেডারেশন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাম গণতান্ত্রিক জোট, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, মওলানা ভাসানী পরিষদ, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সমগীত সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ, জাতীয় গণফ্রন্ট, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), সাম্যবাদী আন্দোলন, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা এবং ডাকসু নির্বাচনের ‘অপরাজেয় ৭১ অদম্য ২৪’ ও ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেল।

শহীদ মিনার থেকে বদরুদ্দীন উমরের মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে জানাজার পর জুরাইন কবরস্থানে তার দাফন হওয়ার কথা রয়েছে।