খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের জেরে সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিশমন গঠনসহ আট দফা দাবি জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন। মঙ্গলবার ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সংগঠনটি প্রতিবাদ সমাবেশ করে এসব দাবি তুলে ধরে।
খাগড়াছড়িতে চলমান উত্তেজনার সূত্রপাত হয় বুধবার; আগের দিন রাতে ‘অচেতন অবস্থায়’ ক্ষেত থেকে এক মারমা কিশোরীকে উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মঙ্গলবার রাতেই ওই কিশোরীর বাবা ধর্ষণের অভিযোগে সদর থানায় মামলা করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন ভোরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর মধ্যে ধর্ষণের প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় খাগড়াছড়িতে। এই আন্দোলন এক সময় সহিংস হয়ে ওঠে। ১৪৪ ধারা জারির পাশাপাশি অতিরিক্ত সেনা ও বিজিবি মোতায়েনের পরও পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। রোববার ১৪৪ ধারার মধ্যেই গুইমারায় ব্যাপক সহিংসতা হয়। সেখানে গুলিতে নিহত হয় তিনজন।
মঙ্গলবার গুইমারায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের সময় সহিংসতার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠনের তথ্য দিয়েছেন জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার।
এদিন দুপুরে খাগড়াছড়ির ঘটনার প্রতিবাদে শাহবাগে সমাবেশে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন বলেন, “যারা মাদক ব্যবসা করছে, যারা অস্ত্রের ব্যবসা করছে, যারা বিদেশের সাথে মাদক এবং অস্ত্রের চোরাচালানের রুট হিসেবে নিজেদের ব্যবহার করে ফুলে-ফেঁপে অর্থ কামাই করছে, তারা এসব সন্ত্রাসী এবং উস্কানির জন্য দায়ী।”
তিনি বলেন, “তারা একদিকে যেভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে আছে, একটি অংশ আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে। এদের মধ্যে পাতানো খেলা, এদের এক অংশ আরেক অংশের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়ে এই সন্ত্রাস এবং অশান্তিকে জিইয়ে রেখেছে। যখন সাধারণ জনগণ এই সন্ত্রাসের ফাঁদে পা দেয় না, তখন তারা সরাসরি আক্রমণ করে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘হাতে রক্তের দাগ’ লেগে আছে মন্তব্য করে মুশতাক হোসেন বলেন, “যেমন কয়েকদিন আগে, আমাদের এক কিশোরীকে নির্মম নির্যাতন করেছে, দলবদ্ধ ধর্ষণ করেছে। প্রকাশ্যে উস্কানি সৃষ্টি করেছে, যেন পাহাড়ের জনগণ আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়। অথবা তারা এই নির্যাতনকে মেনে নেয়।
“যখন এর বিচার হয়নি, তখন পাহাড়ের জনগণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এবং তাদের সঙ্গে গোটা দেশ রুখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে। এই অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে।”
তিনি বলেন, “আমরা কখনো দেখি নাই, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সময়ে কোনো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র চালিয়ে, বল প্রয়োগ করে হত্যাকাণ্ড করেছে। আমাদের লজ্জ্বা হয় ড. ইউনূস মানবাধিকারে নেতৃত্ব দিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আপনি ক্ষমতা নিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করেছিলেন। আপনার আমলে একের পর এক মানুষের রক্ত ঝরছে। এবার রক্ত ঝরল পাহাড়ি আদিবাসীদের।”
পাহাড়ে ‘উস্কানিদাতাদের’ বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান মুশতাক হোসেন।
সমাবেশে আট দফা দাবি তুলে ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন। দাবিগুলো হল—
খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ‘ধর্ষণের’ অভিযোগের দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং নির্যাতিত কিশোরী ও তার পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং মদদের অভিযোগের বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা।
নিহত ও আহতদের পরিবারকে সুরক্ষা, যথার্থ ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
পাহাড়ে দীর্ঘদিনের সামরিকীকরণ নীতি পর্যালোচনা করে শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক সমাধানের পথে এগোনো।
পাহাড়ে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা, যাতে ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর দমন না হয় এবং জনগণ সত্য জানতে পারে।
খাগড়াছড়ি ও গুইমরার ঘটনায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি যুক্ত করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা।
হত্যার শিকার হওয়া প্রতিটি পরিবারকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করে পার্বত্য সমস্যার স্হায়ী সমাধান করা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন— পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, এএলআরডি এর শামসুল হুদা, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দীপক শীল।