বাহাত্তরের সংবিধান সংস্কার করে রেখে দেওয়ার কথা যেসব মানুষ বলেন, তাদের চিন্তা ‘অত্যন্ত ক্ষতিকর’ বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কেন নতুন সংবিধান রচনার বদলে সংস্কারের পথে এগোলেন।
শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘জুলাই নেটওয়ার্ক’ আয়োজিত ‘সংবিধানের ফাঁদ—সংবিধান ও গণসার্বভৌমত্ব নিয়ে জরুরি বয়ান’ শীর্ষক শহীদ আবু সাঈদ-ওয়াসিম স্মারক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, “যারা বলেন ৭২ এর সংবিধান সংস্কার করা যায়, তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। তাদের চিন্তা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তারা মূলত দিল্লির আধিপত্য ও ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পুনর্বার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি মানে নতুন করে জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করা, যেখানে ফ্যাসিস্ট শক্তি আর টিকতে পারবে না।”
সংবিধান সংস্কারের পক্ষে থাকা মানুষদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “তাদের যুক্তি কী? আগে বলুন কেন সংস্কার করতে চান? আমরা তো বলিনি সংস্কার করতে। নতুন সংবিধান চাই। পুরনো মাফিয়া ও লুটেরাদের নিয়ে বসে আবার জাতীয় সনদ করবেন? আমাদের জুলাই ঘোষণাকে আপনাদের দমন করার অধিকার কে দিয়েছে?”
তিনি বলেন, “যারা ৭২ সালের সংবিধান লিখেছে, তারা পাকিস্তানি শাসনের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে তারা সেই সংবিধান লিখে দিয়েছেন। এটা কেন পবিত্র হবে? কারণ দিল্লি লিখে দিয়েছে? স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ হয়েছিল, তা এই সংবিধান প্রণয়নের জন্য হয়নি।”
নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার জনগণের উল্লেখ করে তিনি বলেন, “৭১ সালে যুদ্ধ হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য, যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল। সেখানে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল না। অথচ এই সংবিধান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, গণঅভ্যুত্থানের পরও জনগণকে বাদ দিয়ে পুরনো প্রশাসন, পুলিশ, আদালত ও সেনাবাহিনীকে বহাল রাখা হয়েছে। “ছাত্ররা চেয়েছিল নতুন জুলাই ঘোষণা হোক, সেটাই নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তি হবে। কিন্তু তারা জনগণের সঙ্গে আলোচনা করেনি। জনগণ বাদ পড়ে গেছে।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর তিন দিন বাংলাদেশের জনগণ সত্যিকারের স্বাধীন ছিল। তখন নতুন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগ নষ্ট হয়েছে। এই সময়ে তিনটি মৌলিক ঘোষণা এসেছিল—ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা যাবে না, প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না, জীবিকা ধ্বংস করা যাবে না। এই ঘোষণার ভিত্তিতেই নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা উচিত ছিল।”
তিনি বলেন, “ছয় মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিচার শেষ হওয়া উচিত ছিল। বিভিন্ন দেশে গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণই সাক্ষ্য দিয়ে বিচার করেছে। কিন্তু এখানে আবারও পুরনো লোকদেরই জায়গা দেওয়া হয়েছে।”
গোপালগঞ্জ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গোপালগঞ্জ কি বাংলাদেশের বাইরে? সেখানে ছাত্ররা গেল কেন—এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কিন্তু খালেদা জিয়াও একসময় বলেছিলেন, ‘তোমরা কি গোপালী?’ বোঝা যায়, গোপালগঞ্জকে একটা আলাদা জায়গা হিসেবে দেখা হচ্ছে।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ছাত্রদের দমন ও শক্তি নিঃশেষ করার চেষ্টা চলছে। আবার ছাত্ররাও ভুল করছে। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য না বোঝায় মানুষ হাহুতাশ করছে। সরকার বদলালেও রাষ্ট্র বদলায়নি।”
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি এবং বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান।