জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) এবং দলটির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার উপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।
এছাড়া জি এম কাদের যে ১০ নেতাকে অব্যাহতি দিয়েছেন তাদের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পদ-পদবি ফিরিয়ে দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মো. নুরুল ইসলাম এ আদেশ দেন।
বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী সাখাওয়াত হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে বাদী পক্ষের আইনজীবী আব্দুল বারী বলেন, আদালত পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জি এম কাদের ও দলের যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক সকল কার্যক্রম পরিচালনায় অস্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।
মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত গঠনতন্ত্রের ২০(১)(ক) ধারা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার জন্যও বলা হয়েছে।
আইনজীবী আরও বলেন, অব্যাহতিপ্রাপ্ত ১০ জনের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পদ-পদবি ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এই ১০ জন হলেন—জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, দপ্তর সম্পাদক-২ এম এ রাজ্জাক খান, প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ (চট্টগ্রাম), নাজমা আকতার (ফেনী), মো. জহিরুল ইসলাম জহির (টাঙ্গাইল), মোস্তফা আল মাহমুদ (জামালপুর), জসীম উদ্দিন (নেত্রকোনা) ও আরিফুর রহমান খান (গাজীপুর)।
২৮ জুন প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পদ থেকে এই ১০ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং জাতীয় পার্টির নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকেও তাদের নাম মুছে ফেলা হয়।
ওই ঘটনায় ১০ জুলাই অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতারা জি এম কাদেরসহ দুইজনকে বিবাদী করে আদালতে মামলা করেন।
বিবাদীর তালিকায় আরও দুজনের (মোকাবিলা বিবাদী) নাম রয়েছে, যাদের বিষয়ে কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি।
মামলায় বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা দলের ‘গঠনতন্ত্র পরিপন্থিভাবে’ জি এম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর জিএম কাদের পার্টির সম্মেলন ও কাউন্সিল করে ‘অবৈধভাবে’ নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করেন।
জাতীয় পার্টির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ২৫ জুন দলের মতবিনিময় সভায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানানো হয়।
এর তিন দিন পর গত ২৮ জুন দলের প্রেসিডিয়াম সভায় এই তিনজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।
“এমতাবস্থা পার্টির চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই তিনজনকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ পার্টির সকল পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এ আদেশ ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।”
মহাসচিব পদ থেকে চুন্নুকে সরিয়ে সেই পদে জি এম কাদের তার আস্থাভাজন প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে বসান।
পূর্বাপর:
জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের ‘পাপ’ থেকে দলকে মুক্ত করতে সম্প্রতি এরশাদের ভাই জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্যোগ নিলে জাতীয় পার্টি আবার ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে।
২৮ জুন চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সম্মেলনের দিন ঠিক করেছিলেন জিএম কাদেরর নেতৃত্বাধীন দলটি। কিন্তু শেষমেষ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, ওই তারিখে প্রধান উপদেষ্টার কর্মসূচি থাকায় সম্মেলনের অনুমতি দেওয়া যাবে না।
এরপর জিএম কাদের সম্মেলন স্থগিত করে দেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। মহাসচিব চুন্নুও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে যেসব দল গঠিত হয়েছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরও এক মঞ্চে এনে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তারা। সেজন্য এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশের নেতাদের সঙ্গেও তারা যোগাযোগ করেন।
পার্টির কর্মীদের একটি অংশের মধ্যে একটি চালু ধারণা হল, বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনাতে হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জিএম কাদেরের ভূমিকা নিয়ে যেহেতু নানা প্রশ্ন রয়েছে, সেজন্য পার্টির ভেতরে যৌথ নেতৃত্ব সৃষ্টি করে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। সেজন্য পুরনো ও নিষ্ক্রিয় নেতাদেরকে যুক্ত করতে হবে।
মূলত ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা থেকে জাতীয় পার্টিকে বের করে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনে জোর দিচ্ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন তালুকদাররা।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সে সময় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, জিএম কাদের ‘একাই সবকিছু’ করতে চান। এর পরিবর্তন চান তারা।
“মেইন জিনিস হচ্ছে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র। আমরা পার্টি থেকে সেটা সরাতে চাই। পার্টিতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে তো লাভ নাই,” বলেছিলেন তিনি।
জিএম কাদেরকে বাদ দিয়ে জাতীয় পার্টির নতুন নেতৃত্ব গঠনের একটি প্রক্রিয়া যে শুরু হয়েছে, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন।
গত ২০ জুন তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় পার্টিকে বাদ দিতে পারছে না। কাজেই জিএম কাদের মাইনাস হয়ে জাতীয় পার্টি– সেটা হল সরকারের পলিসি টু কাম কামিং ইলেকশন। বিএনপি-জামায়াত ওরা আওয়ামী লীগকে থাকতে দেবে না। আর জাতীয় পার্টিকেও বাদ দিতে চাচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু পারছে না, সেহেতু জিএম কাদের মাইনাস, সেটা তারা চায়। কাউন্সিল করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিলে লাঙ্গলও পাবে, এটা তারা বলে বেড়াচ্ছে।”
এর মধ্যে বিরোধীদের সম্মেলনের পাল্টায় নিজের শক্তির জানান দিতে ২৮ জুন দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে বসেন জি এম কাদের।
কিন্তু আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বে জ্যেষ্ঠ নেতাদের ওই অংশটি সম্মেলনের নতুন তারিখের ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন।
এক বিবৃতিতে তারা বলেন, “আমরা দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানাই, চেয়ারম্যান যেন অবিলম্বে একগুঁয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতার পথ থেকে সরে এসে দলের প্রতিষ্ঠাতা পল্লিবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অবিলম্বে সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করেন।”
জাতীয় পার্টির ওই অংশের একজন নেতা সে সময় বলেন, পার্টি অফিসে সম্মেলন করার জন্যও তারা প্রশাসনের অনুমতি পাননি। মূলত সে কারণেই তারা অবস্থান বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তারা জি এম কাদেরকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছেন। দল ভাঙার দায় না নিয়ে তারা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে চান।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ২৭ জুন বলেন, “চীন মৈত্রীর বরাদ্দ বাতিলের পর কাকরাইলে কাউন্সিল করার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে তো চেয়ারম্যান মহাসমাবেশ আহ্বান করেছে। সব মিলিয়ে আপাতত সম্মেলন করছি না।”
আর জিএম কাদেরের পক্ষে শামীম হায়দার পাটোয়ারী সেদিন বলেন, “আমরা তো সম্মেলন স্থগিত করেছি। পরে আপনাদের সম্মেলনের তারিখ জানিয়ে দিব। আপাতত কোনো প্রোগ্রামও আমরা করছি না।”
দুই পক্ষ এক পা করে পিছু হটায় সে সময় দলের কর্মীদের উত্তেজনা কিছুটা কমলেও এক সপ্তাহের মাথায় নতুন পদক্ষেপ নিলেন জিএম কাদের।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মত ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে, ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা ভাঙন হয়।
কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে, ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাপায় পঞ্চমবারের মত ভাঙন দেখা দেয়।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়।