একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা এবং দুর্নীতির প্রতিবাদে কাঠমান্ডুর রাস্তায় নামা জেন-জি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অন্তত ১৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে নিহতের এ সংখ্যা জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম।
ক্রুদ্ধ বিক্ষোভকারীরা কারফিউর বিধিনিষেধ ভেঙে পার্লামেন্টের কাছে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়ার পর নেপালের রাজধানীতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের গাছের ঢাল ও পানির বোতলের পাল্টায় পুলিশ জলকামান, কাঁদুনে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়েছে। কিছু বিক্ষোভকারী পার্লামেন্ট প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন কার্যালয় কারফিউর আওতা বাড়িয়েছে। শুরুর দিকে কর্তৃপক্ষ কেবল রাজধানীর বানেশ্বর এলাকায় কারফিউ দিয়েছিল। সহিংসতার পর নতুন করে প্রেসিডেন্টের বাসভবন শীতল নিবাস, মহারাজগঞ্জের লাইনচুরে ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসভবন, সিঙ্গা দুর্বার এলাকার সব অংশ, বালুওয়াটারে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও সংলগ্ন এলাকায় কারফিউ জারি হয়েছে। স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই কারফিউ বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বানেশ্বরে বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে কান্তিপুর টেলিভিশনের সাংবাদিক শ্যাম শ্রেষ্ঠাও রাবার বুলেটে আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির শহর দামাকেও বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। কাঠমান্ডুতে সহিংসতার পর নেপালের বিভিন্ন অংশেও বিক্ষোভের খবর মিলছে। পোখারায় বিক্ষোভকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভাঙচুর করার পর সেখানেও কারফিউ জারি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী ওলি।
কয়েক ডজন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ও দেশজুড়ে বিদ্যমান দুর্নীতির সংস্কৃতির অবসান চেয়ে সোমবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল তরুণরা। নেপালের সরকার শুক্রবার ২৬টি অনিবন্ধিত প্ল্যাটফর্ম ব্লক করে দেওয়ার পর ফেইসবুক, এক্স, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাইটগুলোতে ঢোকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটির লাখ লাখ ব্যবহারকারী ক্রুদ্ধ ও হতাশ হয়। নেপালে লাখ লাখ ব্যবহারকারী ইনস্টাগ্রামের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোতে নিয়মিত ঢোকে; বিনোদন, খবর ও ব্যবসার জন্যও অনেকে এসব প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল।
সোমবার কাঠমান্ডুতে তরুণদের কর্মসূচি শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে; পরে তারা জাতীয় পতাকা উড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। ২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ইউজান রাজভাণ্ডারি বলেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আমাদের টনক নড়িয়েছে, যদিও এখানে একত্রিত হওয়ার এটিই একমাত্র কারণ নয়। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ করছি, কেননা দুর্নীতি নেপালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।”
আরেক শিক্ষার্থী, ২০ বছর বয়সী ইক্ষমা তুমরক বলেন, সরকারের ‘কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি’ তাকে ক্ষুব্ধ করেছে। “আমরা পরিবর্তন দেখতে চাই। অন্যরা এসব মেনে নিয়েছে, কিন্তু আমাদের প্রজন্মের হাতে এর শেষ হবে।”
ফেইসবুক, এক্স ও ইউটিউবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর নেপালে সাধারণ মানুষের কষ্ট এবং রাজনীতিকদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপন ও ছুটি কাটানোর তুলনা দিয়ে করা অনেক ভিডিও টিকটকে ভাইরাল হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় না পড়ায় টিকটক এখনও দেশটিতে সচল রয়েছে।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ভুমিকা ভারতী বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে, সরকার ভয় পাচ্ছে এখানেও সেরকম কিছু হবে।”
নেপালের সরকার গত মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধন, যোগাযোগের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং অভিযোগ সমাধান ও নিয়মনীতি মানা হচ্ছে কিনা তা দেখতে দুই কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে ৭ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিল। রোববার এক বিবৃতিতে সরকার জানায়, তারা মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতাকে সম্মান করে এবং এসবের সুরক্ষা ও অবাধ ব্যবহার নিশ্চিতের পরিবেশ তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
নেপাল এর আগেও জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। অনলাইন জালিয়াতি ও অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়াকে কারণ দেখিয়ে জুলাইয়ে সরকার ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রাম বন্ধ করে দিয়েছিল। আর গত বছরের অগাস্টে টিকটকের ওপর থাকা ৯ মাসের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়, কারণ প্রতিষ্ঠানটি নেপালের আইনকানুন মানতে সম্মত হয়েছিল।