গণফোরামের এমিরেটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন বার্ধক্যজনিত জটিলতা ও বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়ার সম্ভাবনাও ভাবছেন দলের নেতারা।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে রোববার ভর্তি হওয়ার পর সোমবার ইউরিনারি ব্লাডারে একটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে বলে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান জানিয়েছেন। মিজানুর রহমান বলেন, “আগামীকাল (বুধবার) সকালে ডাক্তাররা বোর্ড গঠন করে বসবেন পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী যদি বিদেশে নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে।”
ড. কামাল হোসেন ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর দুই বছর আগে রাজনীতি থেকে অবসানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের হাত ধরে শুরু হওয়া ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের শেষ তিন দশক তিনি ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু গণফোরামের নেতৃত্বে ছিলেন। দলের এক বছরের দুর্বলতা পরবর্তী সময়ে তিনি অবসরের ঘোষণা দেন। ১৯৯৩ সালে নিজ হাতে গড়া দলের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেন। রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলেও দেশের জন্য সাধ্যমত কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তিনি।
সবশেষ ২০২৪ সালে দলের কাউন্সিলে নতুন কমিটিতে ড. কামাল হোসেনকে এমিরেটাস সভাপতি ও মোস্তফা মোহসীন (মন্টু)কে সভাপতি করা হয়। সাধারণ সম্পাদক হন মো. মিজানুর রহমান।
ড. কামাল হোসেন রাজনীতিতে সব সময়ই ছিলেন বড় নাম। পাকিস্তান আমলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবীদের একজন ছিলেন। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছাড় দেওয়া আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুক্তি পান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে ফেরেন। ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের ৬৫ শতাংশের বিপরীতে নৌকা নিয়ে ২৬ শতাংশ ভোট পান। সেই সময় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দলের নীতি নির্ধারণে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।
সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর তিনি সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তুললেও পরে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। শেখ হাসিনার কাছে দেওয়া এক চিঠিতে তিনি নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেন।
১৯৯২ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে গণতান্ত্রিক ফোরামের উদ্যোগ নেন। ১৯৯২ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের পর সভাপতিমণ্ডলীর পদ হারান। ১৯৯৩ সালের অগাস্টের শেষ দিকে গণফোরামের তিনব্যাপী জাতীয় মহাসম্মেলন আহ্বান করা হয়, যা থেকে ২৯ অগাস্ট গণফোরাম গঠনের ঘোষণা আসে।
১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ভোটে অংশ নেন গণফোরাম, তবে সারা দেশে মোট ভোটের মাত্র ০.১৩ শতাংশ পান। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সব বিরোধী দলকে এক মঞ্চে নিয়ে মহাজোট গঠনের চেষ্টা করে, তখন এক মঞ্চে ওঠেন তিনি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোটে যান এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতায় পরিণত হন। নির্বাচনের আগে তিনি বলেছেন, জামায়াত থাকলে তিনি ভোটে অংশ নিতেন না। তবে ভোটের পরে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক টানাপড়েনের শিকার হন। বারবার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান করেও নিজের দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেননি। নির্বাচনের আগে দলের মধ্যে রেজা কিবরিয়াকে কেন্দ্র করে ভাঙন শুরু হয়।