মালয়েশিয়া কর্মী পাঠানোতে ১১৫৯ কোটি টাকা আত্মসাত: ১৩ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা সিদ্ধান্ত

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে ‘সিন্ডিকেট’ করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৩ রিক্রুটিং এজেন্সির কর্তা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, শ্রমিকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে পাঁচগুণ পর্যন্ত অর্থ নিয়ে এজেন্সিগুলো এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এ বিষয়ে রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানান, অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। নতুন মামলায় আসামির সংখ্যা হতে পারে ৩১ জন।

এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আহম মোস্তফা কামালের প্রতিষ্ঠানসহ ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে একই অভিযোগে মামলা করেছিল দুদক।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য

২০২২ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) বিভিন্ন পদে থেকে সংশ্লিষ্টরা সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি করেছেন। সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার পরিবর্তে শ্রমিকদের কাছ থেকে ৫ গুণ বেশি অর্থ আদায় করা হয়।

এছাড়া মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে নির্ধারিত নিয়ম এড়িয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চুক্তির বাইরে শ্রমিক পাঠানো হয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে শ্রমিকদের পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, এভাবে মোট ১ হাজার ১৫৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিং করা হয়েছে।

কোন এজেন্সি কত টাকা আত্মসাৎ করেছে

  • আকাশ ভ্রমণের মনসুর আহমেদ কালাম: ১৩৫ কোটি ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা
  • উইনার ওভারসিজ লিমিটেডের রহিমা হক ও মাহফুজুল হক: ৫৯ কোটি ৮৩ লাখ ১০ হাজার টাকা
  • শাহীন ট্রাভেলসের এম. শাহাদাত হোসাইন (তসলিম): ১২৩ কোটি ৯৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা
  • নাভিরা লিমিটেডের শেখ মোহাম্মদ শাহিদুর রহমান, মাহবুবুর রহমান ও মো. শামিম হাসান: ৮১ কোটি ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা
  • আদিব এয়ার ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মো. কে.এম. মোবারক উল্লাহ, মো. আবুল কালাম আজাদ, নওশাদ আরা আক্তার ও হাছনা আক্তার আজাদ: ১৩২ কোটি ২৭ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা
  • ইউনাইটেড ম্যানপাওয়ার কনসালটেন্স লিমিটেডের নাজমা আক্তার, জেডইউ সায়েদ, জুহানা সুবাইতা ও জিসান সায়েদ: ৫৯ কোটি ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা
  • গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজের রেহানা আরজুমান হাই: ৭৯ কোটি ৬১ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা
  • পি. আর. ওভারসিজ লিমিটেডের ইমান আকতার পুনম ও গোলাম রাকিব: ৭৯ কোটি ৮৪ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা
  • জাহারত অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের মুহাম্মদ শফিকুল আলম (ফিরোজ), নাহিদা আক্তার রওশন আরা পারভিন ও এ.কে.এম. মোশারফ হোসেন: ১১৬ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা
  • অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সির মহিউদ্দিন আহমেদ: ৫৩ কোটি ২৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা
  • মেসার্স জান্নাত ওভারসিজের লিমা বেগম: ৬৩ কোটি ৫৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা
  • মিডওয়ে ওভারসিজ লিমিটেডের মোহাম্মদ রফিকুল হালদার ভূঁইয়া ও কাজী অদিতি রুবাইয়াত: ৬২ কোটি ২৯ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ টাকা
  • সাউথ পয়েন্ট ওভারসিজ লিমিটেডের মঞ্জুর কাদের, সাদিয়া মঞ্জুর, আহমেদ আতাউর রহমান, আহমেদ খালেদ লুবনানী ও আহমেদ ফয়সাল রমাদানী: ১১২ কোটি ৭৭ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা

সংশ্লিষ্টদের অবস্থান

অভিযোগ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সাবেক সভাপতি ও শাহীন ট্রাভেলসের এম. শাহাদাত হোসাইন তসলিমের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে দেশে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি বলেও জানিয়েছেন হাব ও ট্রাভেল এজেন্সি সংশ্লিষ্টরা।

পূর্বের মামলা ও সামগ্রিক চিত্র

দুদকের হিসাবে, নতুন ১৩ এজেন্সি এবং আগের ১২ এজেন্সি মিলিয়ে মোট ২৫টি প্রতিষ্ঠান ও ৬৪ আসামি এ জালিয়াতিতে জড়িত। শ্রমিকদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করে মোট ২ হাজার ২৮৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

২০১৮ সালে বিভিন্ন অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করেছিল। পরে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর নতুন করে শ্রমিক নেওয়ার চুক্তি হয়। সে সময় শ্রমিক ভিসায় যেতে সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার ৫৪০ টাকা ফি নির্ধারণ করে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

চুক্তির আওতায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০টি নির্ধারিত রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক পাঠাত। ২০২১ সালে নতুন সমঝোতা স্মারকে এ সংখ্যা ১০০ করা হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, সেখানে নতুন করে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে এবং ২০–২৫টি এজেন্সি পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।