আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মিল থাকায় তরুণদের দুটি দল—গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—‘একীভূত’ হচ্ছে, এমন আলোচনার মধ্যে বিকল্প চিন্তাভাবনার কথাও উঠে আসছে। ফলে দুই দলের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এনসিপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একীভূত দলের নেতৃত্বে কার কী অবস্থান হবে—এ নিয়ে মতপার্থক্য দূর করা যাচ্ছে না। নেতৃত্বের হিস্যা নিয়েই মূলত একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “একীভূত হওয়ার বিষয়টি এখনও আলোচনার পর্যায়ে আছে। বিকল্প অন্য কোনো উপায়ে একসাথে পথ চলা যায় কি না, সেই বিষয়টিও দুই দলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।”
দল দুটির একীভূত হওয়ার খবরটি গত সপ্তাহে প্রকাশ্যে আসে।
অভ্যুত্থানের পর এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তুলে ধরে আত্মপ্রকাশ করে এনসিপি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটায় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর আহত হওয়ার পর দুই দলের নেতাদের মধ্যে একত্রিত হওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
পরে একীভূত হওয়ার জন্য দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ১৫ জন প্রতিনিধি কয়েক দফা আলোচনায় বসেন। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এবং গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খাঁন একীভূত হওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যে ইতিবাচক বক্তব্য দেন।
তবে দুই দলের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা একীভূত হওয়া যতটা সহজ ভেবেছিলেন, বিষয়টি ততটা কঠিন বলে মনে করছেন। তাই একীভূত হওয়ার বিকল্প হিসেবে জোটবদ্ধ আন্দোলন কিংবা বিষয়ভিত্তিক আন্দোলনের চিন্তা করছেন শীর্ষ নেতারা।
জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক মো. আবু হানিফ বলেন, “এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে আদর্শগত ও কর্মসূচিগত অনেক মিল রয়েছে। উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি), জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচন ও জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে আমাদের কর্মসূচি একই। সেই কারণে একীভূতকরণের আলাপটি উঠেছিল।
“একীভূতকরণ বেশ জটিল প্রক্রিয়া বিধায়, আমরা বিকল্প চিন্তাও করছি। আগামী দিনে কীভাবে একসঙ্গে পথ চলা যায়, সেই ধরনের একটা প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেটা একীভূতকরণও হতে পারে, আবার জোটবদ্ধ বা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনও হতে পারে।”
কোটা আন্দোলন থেকে দুই দলের উত্থান
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নুরুল হক নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদের একাংশ গত বছর একই দাবিতে আন্দোলনে নামে এবং সেই ধারাবাহিকতায় অভূতপূর্ব এক গণঅভ্যুত্থান দেখেছিল বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নুর ভিপি নির্বাচিত হন। সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছিলেন আখতার হোসেন, যিনি এখন এনসিপির সদস্য সচিব। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সংস্কৃতি সম্পাদক এবং আকরাম হোসেন সাহিত্য সম্পাদক পদে একই প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছিলেন।
বাংলাদেশে মোদীর সফরবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন ভারতবিরোধী কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকা এই তরুণরা এক সময় আলাদা হয়ে যান। আখতার হোসেনের নেতৃত্বে একটি অংশ প্রথমে ‘ছাত্র শক্তি’ নামে কার্যক্রম শুরু করে। পরে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নাম নেন।
এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এই অভ্যুত্থানের মধ্য থেকে এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি চলতি মাসেই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাচ্ছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, এক সময়কার ছাত্র অধিকার পরিষদের শীর্ষনেতা নুরুল হক নুর ২০২১ সালে গঠন করেন রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদ। অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর গত বছরের ৩১ অগাস্ট ‘ট্রাক’ প্রতীকে এই দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়।
ভাঙন ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এনসিপি জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতে সক্রিয় হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে কয়েক দফা বিক্ষোভ ও সংঘর্ষেও জড়িয়েছে দলটি।
এনসিপির হাসনাত আব্দুল্লাহ ডাকে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় অবস্থান কর্মসূচির জেরে গেল মে মাসে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আসে।
রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও দুই দলের অবস্থান কাছাকাছি। এছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে নতুন এক রাজনৈতিক বলয় গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিপি।
নেতৃত্বের হিস্যা নিয়েই বড় বাধা
বর্তমানে এনসিপির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি ২১৭ সদস্যের, যা অল্প সময়েই আরও বিস্তৃত হয়েছে। শ্রমিক, আইনজীবী, পেশাজীবী, যুবশক্তি ও প্রবাসী শাখাসহ বিভিন্ন শাখা গড়ে তুলেছে দলটি। গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যাও ২৫০ জনের বেশি।
এনসিপির গঠন কাঠামোয় ১০ সদস্যের ‘পলিটিক্যাল কাউন্সিল’ রয়েছে। এর সদস্যরা হলেন—নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, নাসিরউদ্দীন পাটওয়ারী, সামান্তা শারমিন, তাসনিম জারা, নাহিদা সারওয়ার নিভা ও আব্দুল হান্নান মাসউদ। এর বাইরে রয়েছে ৫১ সদস্যের নির্বাহী কাউন্সিল।
এনসিপির নির্বাহী কাউন্সিলের কয়েকজন নেতা জানান, গণঅধিকার পরিষদের কয়েকজন শীর্ষ নেতার জন্য এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদ ছাড়ার কথা চিন্তা করছিলেন তারা। কিন্তু ইতোমধ্যেই গণঅধিকার পরিষদে নেতৃত্বের একাধিক স্তর তৈরি হয়েছে। এসব স্তরকে জায়গা দিতে গেলে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে। সে কারণে একীভূত হওয়ার চেয়ে যুগপৎ আন্দোলনের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন দুই দলের নেতারা।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন রোববার বলেছিলেন, “তিন দিন আগে দুই পক্ষের অন্তত ১৫ জন শীর্ষ নেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছি।”
তবে মঙ্গলবার এনসিপির কয়েকজন শীর্ষ নেতা জানান, একীভূত হওয়ার আলোচনা প্রায় থেমে গেছে। এখন বিকল্প কোনো উপায়ে একসাথে রাজনীতি করা যায় কিনা—সেই ভাবনাই জোরদার হচ্ছে।