রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি এই সংকটের স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকার ও রাখাইনের অন্যান্য অংশীদারদের ওপর ‘চাপ’ বাড়াতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “এই সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা, আর তাদের পরেই বৃহত্তম ভুক্তভোগী হল বাংলাদেশ। আমাদের মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। আমরা শুধুমাত্র দায়িত্বশীল প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে মানবিক দায়িত্ব পালন করছি।”
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও গণহত্যার মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে। কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়, যেখানে আগে থেকেই আরও চার লাখ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছিলেন।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই বছরের শেষের দিকে মিয়ানমারের অং সান সু চির সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে তারা দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পরিচয় নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলাকালীন ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি, ফলে আলোচনা ভেস্তে যায়।
এরপর কোভিড মহামারীর কারণে আন্তর্জাতিক মনোযোগ কমে যায়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সু চির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং, যা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় নতুন ধাক্কা আনে। চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের কারণে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আংশিকভাবে আড়ালে চলে যায়।
রাখাইনে চলমান যুদ্ধের কারণে গত এক বছরে আরও এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বড় পরিসরে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইউনূস বলেন, “মিয়ানমারে চলমান সংঘাত সমগ্র অঞ্চলের জন্য গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না, বরং রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করছে। আট বছর পার হলেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই নতুন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে। সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর অধিকার বঞ্চনা ও নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে।”
তিনি সতর্ক করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের ‘প্রান্তিকীকরণের প্রক্রিয়া’ চলতে দেওয়া যাবে না। “বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ডের ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার প্রতিকার নেওয়া এখনই সম্ভব। পূর্ণাঙ্গ জাতীয় রাজনৈতিক মীমাংসার অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।”
রাখাইনের সমস্যার চূড়ান্ত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ইউনূস বলেন, “এতে রাখাইন অঞ্চলের সকল জাতিসত্তার অংশগ্রহণ জরুরি, যাতে রোহিঙ্গারা সমঅধিকার ও নাগরিকত্বসহ সমাজের অংশ হতে পারে।”
কক্সবাজারে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি জানান, “তহবিল সংকটের কারণে ক্যাম্পগুলোতে ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ইতোমধ্যে জরুরি সহায়তা কার্যক্রমে তহবিল ঘাটতির বিষয়ে সতর্ক করেছে। নতুন তহবিল না এলে মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে মাথাপিছু মাত্র ৬ মার্কিন ডলারে নামতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের অনাহার ও অপুষ্টিতে ফেলতে পারে এবং আগ্রাসী পদক্ষেপের দিকে ঠেলে দিতে পারে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “তহবিলের অতিরিক্ত কাটছাঁট হলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাই বিদ্যমান দাতাদের সাহায্য বাড়াতে এবং সম্ভাব্য নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানাচ্ছি।”
বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “মানবিক সহায়তার জন্য নতুন ও বর্ধিত তহবিলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকার ও রাখাইনের অংশীদারদের উপর ইতিবাচক পরিবর্তন ও দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোকেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
ইউনূস আরও বলেন, “রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সবসময় সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।”
জাতিসংঘে আয়োজন করা বিশেষ সম্মেলনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “৩০ সেপ্টেম্বরের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন বিশ্বব্যাপী দৃঢ় সংকল্প তৈরি করবে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য বাস্তব সহায়তা নিশ্চিত করবে। তহবিল সংগ্রহ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। আন্তর্জাতিকভাবে রোডম্যাপ গৃহীত হলে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে।”
