গাজা সংকটের সমাধানে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের

ইসরায়েলের হামলা-আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের গাজায় সৃষ্ট তীব্র মানবিক সংকটের পরিস্থিতি দূর করতে জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবি জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমি আবারও জোরালো দাবি জানাচ্ছি যে, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমারেখার ভিত্তিতে, যেখানে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকবে, তখনই ন্যায়বিচার সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হবে।”

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত ৯টা ২৫ মিনিটে তিনি ভাষণ দেন। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে বিশ্ব নেতাদের সামনে তিনি দ্বিতীয়বারের মত ভাষণ দেন বাংলা ভাষায়।

ভাষণে গাজায় চালানো বর্বরতার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্র আমরা দেখছি গাজায়। শিশুরা না খেয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সঙ্গে আমরাও একমত যে, আমাদের চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মানবজাতির পক্ষ থেকে এর অবসানে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।”

গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত নারী ও শিশুসহ ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা সিটিকে পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ইসরায়েল। খাদ্যাভাব চলছে দুর্ভিক্ষের মতো। তীব্র মানবিক এ সংকট সমাধানে সেখানে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানেই জোর দিচ্ছেন অনেক দেশ ও বিশ্ব নেতারা।

গাজায় মানবিক সঙ্কট ও পশ্চিম তীরে বসতিস্থাপন নিয়ে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া। একই পথে হেঁটেছে পর্তুগাল, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নিউজিল্যান্ড ও লিশটেনস্টাইনও।

গাজায় শান্তি স্থাপনে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই ন্যায্য ও টেকসই মনে করে স্বীকৃতি দিচ্ছে তারা। এই সমাধান পথ অনুযায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে। ইসরায়েলের সঙ্গে একটি করিডোরের মাধ্যমে সংযোগ থাকবে।

গাজায় সংকট সমাধানে যখন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া পশ্চিমা দেশের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে, তখনও গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নিধন অভিযান চলছে। গাজা সিটির গভীর থেকে গভীরে ঢুকছে ইসরায়েলের ট্যাংক। ফিলিস্তিনকে পশ্চিমাদের দেওয়া রাষ্ট্রের স্বীকৃতি যুদ্ধের ভয়াবহতা থামাতে পারেনি— সে কথাই গাজাবাসীকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েলি ট্যাংক।

ইসরায়েলের টানা প্রায় দুই বছরের আগ্রাসনের পর কূটনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশ্ব নেতারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বাগত জানাতে জাতিসংঘ সম্মেলনে জড়ো হওয়ার মধ্যেই গাজায় অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েল।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের একটি শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যেখানে সর্বস্তরে সহনশীলতা, অহিংসা, সংলাপ ও সহযোগিতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে। গত সাড়ে তিন দশক ধরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে আমাদের অংশগ্রহণ, বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি আমাদের নিরবচ্ছিন্ন অঙ্গীকারের এক বাস্তব প্রমাণ। এমনকি এই মুহূর্তে প্রায় ৬ হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে জাতিসংঘের আওতায় দায়িত্ব পালন করছেন এবং আজ পর্যন্ত মোট ১৬৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী তাদের দায়িত্বপালনকালে শহীদ হয়েছেন।”