তিন মাসে দুদকের ছয় কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত, বদলি ৬৯ জন

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ছয় কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন; বদলি করা হয়েছে ৫১ কর্মকর্তা ও ১৮ কর্মচারীসহ মোট ৬৯ জনকে।

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য এবং ১০ শিল্পগোষ্ঠীর ‘পাচার করা’ অর্থ ফেরাতে যে ১১টি যৌথ তদন্ত দল (জেআইটি) কাজ করছে, বদলির তালিকায় সেসব দলের কর্মকর্তাও আছেন। বদলি করা হয়েছে দলের প্রধানকেও।

স্বল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া এসব পদক্ষেপের ভিন্ন ভিন্ন কারণ তুলে ধরা হয়েছে আদেশে।

দুদকের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিটের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অন্তত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা–কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দায়িত্বে গাফিলতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়সহ নানা ‘গুরুতর’ অভিযোগ রয়েছে। এর ভিত্তিতে কারণ দর্শানোর নোটিস, বিভাগীয় ব্যবস্থা, বদলি ও সাময়িক বরখাস্তের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, “প্রশাসনিক কারণে বদলি করাটা রুটিন কাজের অংশ।”

তবে তিন মাসের মধ্যে কমিশনের সাময়িক বরখাস্তসহ একাধিক বদলির ঘটনা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে কেউ বলছেন, অনিয়ম করলে ছাড় পাওয়া যাবে না—এমন বার্তা দিতে চাইছে কমিশন। এতে দুদকের সুনাম বাড়বে বলে তাদের ধারণা। আবার কেউ আশঙ্কা করছেন, একের পর এক বদলির কারণে বিশেষ করে যৌথ তদন্ত কাজের গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে। সাময়িক বরখাস্ত ও বদলির কারণে ভয়ের পরিবেশও তৈরি হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।

২৯ সেপ্টেম্বর উপপরিচালক শেখ গোলাম মাওলাকে ঠাকুরগাঁও সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়। এর আগে তিনি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তার স্ত্রী-সন্তানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে গঠিত যৌথ তদন্ত দলের প্রধান ছিলেন।

জেআইটির সদস্য উপপরিচালক রাশেদুল ইসলামকে আগে কক্সবাজারে বদলি করা হলেও তদন্ত কাজে প্রভাব এড়াতে পরে আবার প্রধান কার্যালয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে অন্য দুটি দলের নেতা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ও মো. সালাহউদ্দিনকে বদলি করার পর আর ফিরিয়ে আনা হয়নি।

গত ২১ সেপ্টেম্বর দুদকের সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. রাজিব হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আদেশে উল্লেখ করা হয়, গোয়েন্দা অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে।

এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয় দুদকের পরিচালক খান মো. মীজানুল ইসলামকে। আদেশে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অনৈতিক সুবিধা’ নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নেন মাহাবুবুল আনামের দেওয়া গ্যারান্টির ভিত্তিতে, চিকিৎসা ব্যয় নিজে না মিটিয়ে।

আরও আগে, ১৭ জুলাই সময়মতো অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় সাময়িক বরখাস্ত হন উপপরিচালক কমলেশ মন্ডল। তাকে ঢাকা ওয়াসার ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’-এর দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেননি এবং সময় বাড়ানোর আবেদনও করেননি।

দুদক বলছে, ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি কোনো প্রতিবেদন দাখিল করেননি। এ কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এই ধরনের পদক্ষেপে কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে জানানো হয়। তাদের মতে, অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে নথিপত্র সংগ্রহ, সংশ্লিষ্টদের তলব, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া ইত্যাদি মিলিয়ে সময় যথেষ্ট লাগে। একসঙ্গে একাধিক অভিযোগের দায়িত্ব সামলাতে হয়। তাই কেবল দেরিতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার অভিযোগে ব্যবস্থা নিলে তা কর্মকর্তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ছোটোখাটো ভুলত্রুটি হলেও এখন যে কোনো সময় কারণ দর্শানোর নোটিস বা বিভাগীয় ব্যবস্থার মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

অন্যদিকে ইতিবাচক দিক হিসেবে অনেক কর্মকর্তা বলছেন, এতে কমিশনে সুশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, ‘ফাইলভিত্তিক’ তদবির কমে গেছে এবং এ ধারা বজায় থাকলে দুদকের প্রতি আস্থা বাড়বে।

তবে কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার পরিবর্তনের পর দুদকেও রদবদলের সূত্র ধরে কিছু কর্মকর্তা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ‘অনৈতিক সুবিধা’ নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। তাদের জন্যও এ ধরনের পদক্ষেপ বার্তা হিসেবে কাজ করবে।

এসব বিষয়ে জানতে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।