শাপলা প্রতীক বরাদ্দে অনড় নির্বাচন কমিশন: এনসিপির দাবি প্রত্যাখ্যান

ভোটের প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে— কোনো দলকেই শাপলা প্রতীক দেওয়া হবে না এবং এ বিষয়ে কমিশন কোনো ধরনের চাপের মধ্যে নেই।

ইসি জানায়, আইন, সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) প্রতীক বরাদ্দ বিধি অনুযায়ী কোনো দলকে শাপলা প্রতীক দেওয়ার সুযোগ নেই। কমিশনের এই অবস্থান পুনরায় স্পষ্ট করা হয় যখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন করে শাপলা প্রতীক দাবি জানায়।

এর আগে একদলকে এ প্রতীক না দেওয়ার বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এনসিপি ফের প্রতীক তালিকা সংশোধন করে তাদের ‘শাপলা’ প্রতীক দেওয়ার অনুরোধ জানায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের দাবির কথা তুলে ধরে।

পরদিন শুক্রবার কমিশন আগের সিদ্ধান্তই পুনর্ব্যক্ত করে জানায়, শাপলা প্রতীক কোনোভাবেই বরাদ্দ দেওয়া হবে না। নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আমরা কোনো চাপে নেই। আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে আমরা শাপলা প্রতীক দিতে পারি না।”

এর আগে নাগরিক ঐক্যও দলীয় প্রতীক হিসেবে কেটলির পরিবর্তে শাপলা চেয়েছিল, কিন্তু ইসি তাদের আবেদনও নাকচ করে দেয়। কমিশন এর আগেই জানিয়েছে, জাতীয় প্রতীক ‘শাপলা’কে ভোটের মার্কা হিসেবে ব্যবহার না করার বিষয়ে তাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে।

বৃহস্পতিবারের বৈঠক
বৃহস্পতিবার এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে তিন নেতা সিইসি নাসির উদ্দিনের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “দুই ঘণ্টা আমরা সিইসি ও সচিবকে জিজ্ঞেস করেছি, প্রতীক না দেওয়ার কারণ কী? তারা নিশ্চুপ ছিলেন। আমরা জানিয়ে দিয়েছি, আমাদের নিবন্ধন শাপলা দিয়েই হবে। শাপলা ছাড়া এনসিপি নিবন্ধন নেবে না।”

তিনি আরও বলেন, “যদি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়, তার দায় কিছুটা ইসিকেও নিতে হবে।”

সেদিন রাতে এনসিপির প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদের সঙ্গেও আলাদা বৈঠক করে। অন্যদিকে, একই সময়ে সিইসি নাসির উদ্দিন, কমিশনার তাহমিদা আহমদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ এবং ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ অভ্যন্তরীণ বৈঠক করেন।

ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘শাপলা’ প্রতীক নির্বাচন পরিচালনা বিধিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকায় সেটি বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ইসি এনসিপিকে প্রতীক বাছাইয়ের জন্য চিঠি পাঠায় এবং ৭ অক্টোবরের মধ্যে জানাতে বলে। কিন্তু দলটি ৭ অক্টোবর ফের শাপলাকে প্রতীক তালিকায় যুক্ত করার দাবি জানায়।

ভোট প্রস্তুতি ও কমিশনের অবস্থান
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ভোটার তালিকা, সীমানা নির্ধারণ, দল নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার অনুমোদন, প্রবাসী ভোটার অ্যাপ চূড়ান্ত করা এবং সংলাপ আয়োজনসহ নানা প্রস্তুতি চলছে।

এই সময় প্রতীক নিয়ে বিতর্ককে ‘অপ্রয়োজনীয় চাপ’ হিসেবে দেখছে না ইসি। নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “এখন পর্যন্ত কোনো চাপ অনুভব করছে না ইসি, ভবিষ্যতেও চাপ এলেও তা আমলে নেওয়া হবে না। ফেব্রুয়ারিতে যেকোনো মূল্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে।”

শনিবার চট্টগ্রামে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নিয়ে কর্মশালা এবং রোববার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে সিইসি ও কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের।

‘চাপ অনভিপ্রেত’, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী বলেন, শাপলা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তিনি মনে করেন, দলগুলো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত, চাপ সৃষ্টি করা নয়।

তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি উন্নত হয়নি, কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি ইসির নিয়ন্ত্রণে আসবে। প্রতীক নিয়ে চাপ সৃষ্টি করা অনভিপ্রেত।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতারও ইসির সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা রেখে বলেন, “ইসি যে প্রতীক দেয়, সেটিই চূড়ান্ত। বিশেষ প্রতীক না পেলে ভোটে না যাওয়ার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। ইসি স্বাধীন সংস্থা— তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়।”

তিনি আরও বলেন, “ইসির কাজ হলো সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো বলা যাচ্ছে না; নির্বাচনের আগে নির্বিঘ্ন পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”

সবশেষে, পর্যবেক্ষকরা বলছেন— নির্বাচন কমিশন যদি পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করে, তবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন সম্ভব।