দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসে উত্তাপ বাড়ছে। নির্বাচনের মাঠে এখন আলোচনায় অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, হলে না থাকা শিক্ষার্থীরাই এবারের নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারেন।
তাদের মতে, প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অনাবাসিক হওয়ায় তারা নির্বাচনি আবহ থেকে অনেকটা দূরে। ভোটের দিন তাদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রার্থীরাও অনেক ক্ষেত্রে এই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না, যা ভোটের মাঠে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
নানা উত্তেজনা ও অস্থিরতার পর কয়েক দফা পিছিয়ে আগামী ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে রাকসু নির্বাচন।
১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই মাত্র ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমদিকে রাজশাহী কলেজ ও বড়কুঠিসহ বিভিন্ন স্থানে ক্লাস ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলত। ১৯৫৮ সালে মতিহার এলাকায় ৭৫৩ একর জায়গায় নিজস্ব ক্যাম্পাস নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৯৬৪ সালে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ১২টি অনুষদ, ৫৯টি বিভাগ ও ছয়টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টি আবাসিক হল ও একটি আন্তর্জাতিক ডরমেটরিতে আসন সংখ্যা ৯,৬৭৩—অর্থাৎ মাত্র ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসনের সুযোগ পান। বাকিরা অনাবাসিক।
আবাসন নিয়ে শিক্ষার্থীদের হতাশা
ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসে মেসভাড়া হিসেবে ১,৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকা গুনতে হয়, যেখানে হলে মাসিক ফি মাত্র ১০০ টাকা। খাবারের ক্ষেত্রেও হলে থাকা শিক্ষার্থীরা সুবিধা পান, কিন্তু বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের খরচ তুলনামূলক বেশি।
মেহেরচণ্ডীর ছাত্রাবাসে থাকা তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাহিদ আলী বলেন, “একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তৃতীয় বর্ষেও আমি আবাসিকতা পাইনি। আগে সিট দখলের অজুহাত দেওয়া হত, এখন কেন পাই না বুঝি না।”
চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী রুম্মান বলেন, “আমাদের কাজগুলো হাতে-কলমে। হলে থাকা সহপাঠীরা রাত ১০টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে থাকতে পারে, আমরা নিরাপত্তার কথা ভেবে দ্রুত ফিরি। এতে আমরা পিছিয়ে পড়ি।”
স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী রেদোয়ান ইসলাম বলেন, “ছয় বছরের ক্যাম্পাস লাইফে মাত্র ছয় মাস হলে থাকার সুযোগ পেয়েছি। আমি চাই, বিশ্ববিদ্যালয় শতভাগ আবাসিক হোক।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ফরিদ খান জানান, “শিক্ষার্থীরা এখন নিয়ম মেনে হলে সিট পাচ্ছেন। চারটি নতুন হলের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি হচ্ছে, আরও দুটি হল নির্মাণাধীন। আবাসন সমস্যা সমাধানে পরিকল্পনা চলছে।”
ভোটের মাঠে আবাসন বড় ইস্যু
সপ্তদশ রাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ২৮,৯০১ জন—এর মধ্যে ছাত্র ১৭,৫৯৬ এবং ছাত্রী ১১,৩০৫ জন। কেন্দ্রীয় সংসদে ২৪৮ জন, সিনেটে ৫৮ জন এবং হল সংসদে ৫৯৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রায় সব প্যানেলই তাদের ইশতেহারে শতভাগ আবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী তাসিন খান বলেন, “রাকসুতে অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা বড় ফ্যাক্টর। ভোটের আগে দুই দিন ক্লাস বন্ধ থাকলেও অনেকে ভোট দিতে আসবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।”
‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, “এত বছর পরও আবাসনের দাবি জানাতে হচ্ছে—এটাই আমাদের বাস্তবতা। এটি ফলাফলে প্রভাব ফেলবেই।”
‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’-এর এজিএস প্রার্থী সালমান সাব্বির বলেন, “আমরা অনাবাসিকদের কাছেও যাচ্ছি। তাদের সাড়া আশানুরূপ। আশা করছি, রাকসু নির্বাচনে ভোটের হার ভালো হবে।”
অনাবাসিক ভোটারদের নিয়ে শঙ্কা
রাজশাহী শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরের ২৬টি বাস শিক্ষার্থীদের সেবা দিচ্ছে। শতভাগ আবাসিক না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী প্রতিদিন কাজলা, বিনোদপুর, মেহেরচণ্ডী, বানেশ্বর, পুঠিয়া ও তানোর থেকে যাতায়াত করেন।
ভিপি প্রার্থী তাসিন খান বলেন, “ভোটকেন্দ্র একাডেমিক ভবনে করা হলেও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন, অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা আসবেন কি না। প্রশাসন সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারে।”
কাটাখালি থেকে আসা শিক্ষার্থী ইয়ামিন বলেন, “যারা দূর থেকে ক্লাস করে, তারা রাকসু নিয়ে তেমন ভাবে না। হলে থাকা শিক্ষার্থীরাই এসব বিষয়ে বেশি সচেতন।”
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রাইসুল রিয়াদ বলেন, “যাওয়া-আসায় আড়াই ঘণ্টা লাগে। ভোটের দিন বাস সার্ভিস বাড়ালে আমরাও সহজে ভোট দিতে পারব।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বলেন, “রাকসু আমাদের সবার প্রাণের দাবি। শিক্ষার্থীদের ভোটে উৎসাহ দিতে সভা-সেমিনার করেছি।”
এলাকাভিত্তিক প্রভাব
বিনোদপুর এলাকাকে অনেকেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঘাঁটি হিসেবে উল্লেখ করেন। ‘স্টুডেন্ট ওয়েলফার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ভবনে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয় শিবির, যা ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ভিপি প্রার্থী মেহেদী মারুফ বলেন, “এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে, তবে শিক্ষার্থীরা সচেতন। তারা যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবেন।”
পরিবহন সমন্বয়ে ঘাটতি
ভোটের দিন অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন ও পরিবহন দপ্তরের সমন্বয় জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে পরিবহন দপ্তর জানিয়েছে, “ভোটের দিন সকালে দুইটি ও বিকেলে একটি ট্রিপ চলবে, অতিরিক্ত ট্রিপের বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশ আসেনি।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বলেন, “অন্য সময়ের মতোই বাস চলবে। প্রয়োজনে ট্রিপ বাড়ানোর বিষয়ে পরিবহন দপ্তরের সঙ্গে কথা বলা হবে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সাড়ে তিন দশক পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত রাকসু নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারণে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই একমত।