ভুলের দায়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন জামায়াত আমির, প্রতিশোধের রাজনীতির অবসানের প্রতিশ্রুতি

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বা এর কোনো নেতাকর্মীর মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন দলটির আমির শফিকুর রহমান।

তিনি বলেন, “যখন যেভাবে হোক, মানুষ আমরা কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে না। দল হিসেবে আমরা দাবি করি না যে আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে। এই সংগঠনের প্রতিটি কর্মী, সহকর্মী কিংবা দলের দ্বারা যে যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন; সবার কাছে কোনো শর্ত নাই, বিনা শর্তে মাফ চাই। আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।”

মঙ্গলবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মুক্তিযোদ্ধা হলে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয় জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে তাকে বেকসুর খালাস দেওয়ার পর।

সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত আমির আওয়ামী লীগ আমলে যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচার কার্যক্রম নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন এবং সমসাময়িক বিষয়েও কথা বলেন।

শফিকুর রহমান বলেন, “আপনাদের মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর কাছে আমাদের আহ্বান, অনুরোধ- আমাদের বিপদ ঘাড়ে নিয়েও আমরা চেষ্টা করেছি দেশবাসীর বিপদে পাশে থাকার। এমনকি ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নেওয়ার পরেও আমরা চেষ্টা করেছি শহীদ পরিবার, আহত, পঙ্গু ভাই-বোনদের পাশে থাকার।

“কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, আমরা পুরো কর্তব্য আদায় করতে পারিনি। সীমাবদ্ধতার কারণে একসময় আমাদের করতে দেওয়া হতো না, এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আমাদের কোনো আচরণে, কোনো পারফরমেন্সে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।”

তিনি বলেন, “জাতির অনেকগুলা বার্নিং ইস্যু এখনো আনরিজলভড। এখানেও যেন সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজন জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ভূমিকা রাখতে পারে—আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দান করুন।

“আমরা কথা দিচ্ছি, আল্লাহর ইচ্ছায়, দেশবাসীর সমর্থন ও সহযোগিতায় দেশের সেবা করার দায়িত্ব আমাদের ওপর এলে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রতিশোধের রাজনীতির অবসান ঘটাব। বৈষম্যের রাজনীতির অবসান ঘটাব।”

তিনি আরও বলেন, “সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করার জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আমরা চাই সমাজ দুর্নীতিমুক্ত, দুঃশাসনমুক্ত, অপরাধমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত, কল্যাণধর্মী ও মানবিক হোক। সেই সমাজ গঠনে আমরা আপনাদের সাহচর্য, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সমর্থন ও দোয়া কামনা করি।”

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি ‘ইচ্ছাকৃত নেতৃত্ব গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেন জামায়াত আমির।

এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে খালাস দেওয়ার রায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই রায়ের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, এটা ছিল ইচ্ছাকৃত নেতৃত্ব গণহত্যা।”

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল ও রিভিউ শেষে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষ পাঁচ নেতার ও বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়।

জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যা আপিল বিভাগেও বহাল ছিল। তবে সরকার বদলের পর আজহারের রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে আপিল শুনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মঙ্গলবার সেই রায়ে তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।

জামায়াত আমির বলেন, “এই রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, সত্যকে চেপে রাখা যায় না। সত্য মেঘের আড়াল ভেদ করে আলোর ঝলক নিয়ে আসে। সেই সত্যটাই আল্লাহ আজকে আমাদের দেখালেন।”

তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার আমলে আমরা ভয়ংকর জুলুমের শিকার হয়েছি। আমাদের ১১ জন শীর্ষ নেতাকে মিথ্যা মামলায় সাজানো, পাতানো আদালত এবং মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে কার্যত জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে।”

এ টি এম আজহারের রায়কে ‘সুবিচার’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছে। মামলাগুলো পরিচালনায় সীমাহীন জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর বইয়ে লিখেছেন, কীভাবে বিচার বিভাগ ও সরকার মিলে বিচার নয়, বরং ঠান্ডা মাথায় খুন করার ছক এঁকেছিল।”

তিনি বলেন, “একেকটা রায়ের পর পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মামলাগুলো পরিচালনায় ‘ইন্টারন্যাশনাল কাস্টমারি ল’ কিংবা ‘ডমেস্টিক কাস্টমারি ল’ অনুসরণ করা হয়নি। সেদিন সংবিধান বা আইন কোনো বিষয় ছিল না, যাঁদের ইশারায় কোর্ট পরিচালিত হতো, তাঁদের ইচ্ছাই ছিল মুখ্য। সেটি বৈধ হোক কিংবা অবৈধ।”

তিনি বলেন, “ব্রিটেনের উচ্চ আদালত রায়ে বলেছেন, এই মামলাগুলো ছিল বিচারের নামে ‘জেনোসাইড অব দ্য জাস্টিস’। তাঁরা ‘কিলিং অব দ্য জাস্টিস’ বলেননি, কারণ তা সিঙ্গেল কেস নয়। এখানে একাধিক কেস ছিল। বাংলাদেশের আদালতও বলেছে, এটি ছিল ‘মিসকারেজ অব দ্য জাস্টিস’। এটি ছিল নেতৃত্ব গণহত্যা। উদ্দেশ্য ছিল দলকে নেতৃত্বশূন্য করা। তবে আমরা প্রতিশোধ নেইনি, ন্যায়বিচার চেয়েছি।”