ইরানে পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলা, পাল্টা প্রতিশোধের হুমকি তেহরানের

ইরান যেন পরমাণু অস্ত্র বানাতে না পারে তা নিশ্চিত করতে দেশটির একাধিক পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা এবং সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
ইরানি গণমাধ্যম এবং প্রত্যক্ষদর্শীরাও তেহরানসহ একাধিক শহর ও নাতানজে দেশটির প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে বিস্ফোরণের খবর নিশ্চিত করেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

এই হামলাকে ‘ইসরায়েলের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মোড়’ অভিহিত করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানে তাদের এ অভিযান শেষ হতে কয়েকদিন লাগবে।
আর ইরান বলেছে, তারা শুক্রবারের এ হামলার ‘তিক্ত ও বেদনাদায়ক’ পাল্টা প্রতিশোধ নেবে।

তেহরান দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, পরমাণু অস্ত্র বানানোর লক্ষ্য নেই, তাদের কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ। তবে ইসরায়েল তা মানতে নারাজ।
তেহরানের কাছে এখন যে পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে তাতে তারা ১৫ দিনের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে তেল আবিব শুক্রবার ইরানি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে এ হামলা চালিয়েছে, বলছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।

হামলার পাল্টায় ইরানও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়তে পারে এ আশঙ্কায় ইসরায়েলে জরুরি অবস্থাও জারি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থির করে তোলা এ হামলা নিয়ে বিশ্বের অনেকগুলো দেশই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ইরানে ইসরায়েলের হামলায় তাদের কোনো যোগ ছিল না।
“আজ রাতে ইসরায়েল নিজেরাই ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা ইরানে হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নই, এবং আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার হচ্ছে ওই অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
“স্পষ্ট করে বলতে চাই, ইরানের উচিত হবে না যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বা কর্মীকে নিশানা বানানো,” বলেছেন তিনি।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ফক্স নিউজের উপস্থাপক ব্রেট বেয়ারকে বলেছেন, ইরান পাল্টা হামলা চালালে ইসরায়েলের সুরক্ষায় ‍যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করবে।
“ইরান পারমাণবিক বোমা পেতে পারে না এবং আমরা আলোচনার টেবিলে ফেরার ব্যাপারে আশাবাদী। দেখা যাক। তাদের (ইরান) নেতাদের কয়েকজন আর ফিরে আসবে না,” ট্রাম্প তাকে এমনটা বলেছেন বলে জানিয়েছেন বেয়ার।

যুক্তরাষ্ট্র এ হামলায় জড়িত ছিল না বলে ওয়াশিংটন দাবি করলেও তেল আবিবের ‘অ্যাডভেঞ্চারে’ ওয়াশিংটনেরও সম্পৃক্ততা আছে বলে অভিযোগ করেছে তেহরান।
হামলার বিষয়টি আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছিল বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম।

চীন ইরান ও ইসরায়েলে তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে। ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে পাল্টা হামলা চালাতে পারে আশঙ্কায় ইসরায়েলে থাকা চীনা নাগরিকদের অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এবং সামরিক ও সংবেদনশীল স্থাপনা এড়িয়ে চলতে বলেছে তারা।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র খ্যাত সৌদি আরব ইরানে ইসরায়েলের হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ অ্যাখ্যায়িত করেছে।
“সৌদি আরব এ জঘন্য হামলার নিন্দা জানাচ্ছে। এই আগ্রাসন অবিলম্বে বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও নিরাপত্তা পরিষদের ওপরই দায়িত্ব বর্তায় বলেই মনে করছি আমরা,” বিবৃতিতে বলেছে তারা।

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ওমান বলেছে, “এই ঘটনাকে উত্তেজনা বৃদ্ধির বিপজ্জনক ও বেপরোয়া পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে ওমান, এটি জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের রীতিনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বারবার এমন আগ্রাসী আচরণ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়, এই ধরনের কাজ আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে।”

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সম্প্রতি পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যে আলোচনা চলছিল, তার মধ্যস্থতায় ছিল ওমান। শুক্রবার ইরানে ইসরায়েলের ওই হামলার পর আদৌ ওই আলোচনা অব্যাহত থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
“এই উত্তেজনা এবং এর পরিণতির জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করছে ওমান। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন এই বিপজ্জনক কার্যক্রম বন্ধে কঠোর ও স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করে,” বলেছে তারা।

অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং বলেছেন, “ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার বৃদ্ধিতে অস্ট্রেলিয়া উদ্বিগ্ন। এই উত্তেজনা বৃদ্ধি ইতোমধ্যেই অস্থির একটি অঞ্চলের পরিস্থিতিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। আমরা সব পক্ষকে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া বা বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি, যেগুলো উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।”
“আমরা সবাই বুঝি যে, ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই তারা যেন সংলাপ ও কূটনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়,” বলেছেন তিনি।

গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লাক্সন।
“মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটছে তা সত্যিই অনভিপ্রেত। যে কোনো ভুল হিসাবনিকাশের ঝুঁকি অনেক বেশি। ওই অঞ্চলে আর কোনো সামরিক পদক্ষেপ এবং এর সঙ্গে থাকা ঝুঁকি বাড়ানোর প্রয়োজন নেই,” বলেছেন তিনি।

সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাপানও।
“পরিস্থিতির আরও অবনতি রোধে জাপান সব ধরনের প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি জাপানি নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে,” বলেছেন জাপানের মুখ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিমাসা হায়াশি।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের এক মুখপাত্র বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছেন মহাসচিব।
“মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো ধরনের সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির নিন্দা জানিয়েছেন মহাসচিব। বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা চলাকালে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
“তিনি উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছেন এবং যেকোনো মূল্যে বড় ধরনের সংঘাতের দিকে ধাবিত হওয়া এড়াতে বলছেন। কারণ ওই অঞ্চল আর কোনো গভীর সংকট সহ্য করার মতো অবস্থায় নেই।”