জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় তীব্র বাকবিতণ্ডা

গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক রূপ নেয় তীব্র বাকবিতণ্ডায়। ইরান ও ইসরায়েল, উভয় পক্ষই তাদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে একে অপরকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করে। যুদ্ধ বন্ধ ও কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানানো হলেও, কীভাবে এগোনো উচিত—সে বিষয়ে পরিষদ কোনও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।

দীর্ঘ সময় ধরে সীমিত পরিসরে, সরাসরি ও ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে চলমান দ্বন্দ্বের পর, গত সপ্তাহে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র সংঘাত শুরু হয়। ইসরায়েল অভিযোগ করে, তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, যা তাদের জন্য হুমকি। আত্মরক্ষায় তারা ইরানে বিমান হামলা চালায়। জবাবে ইরানও ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। এই পাল্টাপাল্টি হামলা এখনও চলমান।

বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত আমির সাঈদ ইরাভানি ইসরায়েল ও এর মিত্রদের তেহরানে আগ্রাসনের সমর্থনে ‘অতর্কিত হামলা ও অস্তিত্বের হুমকি’র যুক্তিকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের অজুহাত’ বলে আখ্যা দেন। তিনি ইসরায়েলকে এমন একটি দেশ হিসেবে বর্ণনা করেন, যারা নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে এবং অন্য দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন করে। বক্তব্যের সময় তিনি ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিশুদের ছবি তুলে ধরেন।

জবাবে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন বলেন, ইরান ‘ভুক্তভোগী সেজে নাটক করছে’। তিনি ইরাভানিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা কীভাবে আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে এমন একটি পরিকল্পনার পরিণতি থেকে রক্ষা চাওয়ার সাহস করেন, যে পরিকল্পনা গণহত্যার জন্য তৈরি?’

ব্যক্তিগত আক্রমণ ও দোষারোপে ভরা এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো এমন এক সময়ে, যখন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইরান ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে চলমান আলোচনা অগ্রগতি ছাড়াই মুলতবি হয়ে গেছে। একইসঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ইসরায়েল হামলা বন্ধ না করলে গঠনমূলক আলোচনা সম্ভব নয়।

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা মূলত লড়াই বন্ধ ও কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে মত দেন। তবে কে দায়ী, তা নিয়ে আলোচনায় তীব্র বিতর্ক হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্বর্তী প্রতিনিধি ডরোথি ক্যামিল শে বলেন, ইরানই মধ্যপ্রাচ্যে ‘অস্থিরতা ও সন্ত্রাসের প্রধান উৎস’ এবং তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে থাকবে।

যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের প্রতিনিধিরা কিছুটা সংযত অবস্থান নিয়ে উত্তেজনা প্রশমনের ওপর গুরুত্ব দেন।

রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনার দাবি ‘ভিত্তিহীন গুজব’ এবং এটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির পক্ষ থেকে ছড়ানো হচ্ছে। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোকে ইসরায়েলি আগ্রাসনের ‘সহযোগী’ এবং ‘ভয়াবহ অস্ত্রের মতোই বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেন।

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ১২ জুন জানায়, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে সই হওয়া চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এটি দুই দশকে প্রথমবারের মতো সংস্থাটির পক্ষ থেকে ইরানের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান এমন মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা কেবল পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলো করে থাকে। তবে তারা নিশ্চিত করেনি যে, ইরান সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে।

রাশিয়ার প্রতিনিধি এ প্রতিবেদনকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ এবং ‘ভিত্তিহীন’ বলে আখ্যা দেন।

পরিষদের বৈঠকে চীনের প্রতিনিধি ফু কং কিছুটা নমনীয় অবস্থান নিয়ে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানান এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান করেন। তবে আইএইএ বা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি সরাসরি কিছু বলেননি।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, ইরান বর্তমানে পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে না, তবে চাইলে এক বছরের মধ্যে তা করতে পারে। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তাহলে আমার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভুল করছে।’