শ্রীমঙ্গলে সেপটিক ট্যাংক থেকে মোবাইল তুলতে গিয়ে চারজনের মৃত্যু, শোকের ছায়া চা বাগানে

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হরিণছড়া চা বাগানের বাসিন্দা কৃষ্ণা রবিদাশ প্রতিদিন টমটম নিয়ে বের হলেও সেটি এখন একপাশে পড়ে আছে।
প্রতিবেশী দুই ভাইকে বাঁচাতে সেপটিক ট্যাংকে নেমে মৃত্যু হয়েছে কৃষ্ণার। কিন্তু কৃষ্ণার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার মা এবং স্বজনরা। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা দেওন্তি রবিদাশ।

বুধবার রাতে শ্রীমঙ্গলের সীমান্তবর্তী হরিণছড়া চা বাগানের পশ্চিম লাইনে মোবাইল তুলতে সেপটিক ট্যাংকে নেমে চারজনের মৃত্যু হয়। ১৯ বছর বয়সী কৃষ্ণা রবিদাশ তাদেরই একজন; একই বাগানের জহর লাল রবিদাসের ছেলে। এ ঘটনায় অসুস্থ হয়েছেন আরও একজন।

মৃত বাকিরা হলেন হরিণছড়া বাগানের উদয় পটনায়েকের ছেলে রানা পটনায়েক (১৭), তার ভাই শ্রাবণ পটনায়েক (১৯) ও লক্ষ্মীন্দর ফুলমালির ছেলে নৃপেন ফুলমালি (২৭)।

বৃহস্পতিবার বিকালে কৃষ্ণা রবিদাশের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়িভর্তি মানুষের কান্নার রোল। এ সময় এক নারী পাশের টমটমটি দেখিয়ে বলছিলেন, “ওই যে টমটম দেখছেন কৃষ্ণা ওটাই চালাতো।” তখনই এক নারী কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারালেন। কাছে যেতেই কয়েকজন বলে উঠলেন, তিনি কৃষ্ণার মা দেওন্তি রবিদাশ। তখন জ্ঞান ফেরাতে তার মুখের উপর পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

জ্ঞান ফেরার পর কান্না জড়িত কন্ঠে দেওন্তি রবিদাশ বলেন, “আমার ছেলেটা ওদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনটা দিয়ে দিলো। তার এই টমটম এখন কে চালাবে? কে আমাকে বাজার করে খাওয়াবে?”

একই চিত্র রানা, শ্রাবণ ও নৃপেনের বাড়িতেও। বাগানজুড়ে কারও ঘরে বৃহস্পতিবার দুপুরে চুলায় হাঁড়ি বসেনি। সবাই ব্যথিত, শোকে মুহ্যমান।

সেপটিক ট্যাংকে মোবাইল ফোন তুলতে গিয়ে চার তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় সবাই হতবাক। এত ছোট জায়গায় কীভাবে চারজনের মৃত্যু হতে পারে, সেটি যেন ভেবেই পাচ্ছেন না তারা।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় হরিণছড়া চা বাগানের অধিবাসী সবুজ তজু বলেন, “বুধবার মধ্যরাতে বাগানের পশ্চিম লাইনের রানা পটনায়েক টয়লেটে গেলে এ সময় তার মোবাইল ফোনটি সেপটিক ট্যাংকে পড়ে যায়। তখন সে তার ভাই শ্রাবণ পটনায়েককে ডেকে মোবাইল ফোনটি তুলতে সেপটিক ট্যাংকে নামে। কিন্তু সে উঠে না আসলে শ্রাবণও ট্যাংকে নামেন। এরপর সেও উঠে না আসায় বাগানের অপর তিনজন নৃপেন ফুলমালি, কৃষ্ণা রবিদাশ ও রবিন্দ্র বুনার্জীও ট্যাংকে নামেন।”

তিনি বলেন, “তারা কেউই উঠে না আসলে বাগানের অন্য শ্রমিকরা মিলে দ্রুত তাদের সেপটিক ট্যাংক থেকে তুলে রাত ১টার দিকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে গুরুতর অবস্থায় তাদের মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসক চারজনকে মৃত ঘোষণা করেন। আর অসুস্থ রবিন্দ্র বুনার্জীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে সিলেট এম এ জি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।”

হরিণছড়া চা বাগানের বাসিন্দা দয়াল বুনার্জী বলেন, “যারা এই সেপটিক ট্যাংক দেখছেন তারা সবাই হতবাক হচ্ছেন। মাত্র ৬ ফুট গর্তে পাঁচজন কীভাবে নামলেন আর চারজনই কীভাবে মারা গেলেন, এটা মেনে নিতে পারছেন না বাগানবাসী।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্তন পরিচালক ও মৌলভীবাজারের প্রাক্তন সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন, “সেপটিক ট্যাংকে কয়েক ধরনের গ্যাস জমে। মূলত মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইডসহ বিভিন্ন প্রকার বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাসের সৃষ্টি হয়। এই গ্যাসগুলো মানব জীবনের জন্য মারাত্মক মৃত্যুঝুঁকি বহন করে।”

তিনি বলেন, “সচেতনতার অভাবে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে চা বাগান এলাকায়। এ জন্য প্রয়োজনে আইন করতে হবে। এ বিষয়ে প্রস্তুতি ছাড়া কেউ সেপটিক ট্যাংকে নামতে পারবে না। আর নামলে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে নামতে হবে।”

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে চা বাগান এলাকায় এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক প্রিতম দাশ। তিনি বলেন, “চা বাগান এলাকায় প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন ও চা বাগান কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের সচেতন করতে হবে।”

হরিণছড়া চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক বিকাশ সিংহ বলেন, “এটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। তবে বিষয়টি হলো, কারও স্বজন ওখানে পড়ে গেলে তারা তাকে বাঁচাতে নামতেই চাইবে। এ বিষয়েও কিভাবে নামবে সতর্ক করতে হবে।”

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, “তিনটি পরিবারের চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। প্রত্যেক পরিবারে সৎকারের জন্য জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। পরে আরও সাহায্য করা হবে।”

সেপটিক ট্যাংকে পড়ে যাতে কেউ মারা না যায়, সে জন্য মানুষকে সচেতন করার আহ্বান জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার (শ্রীমঙ্গল সার্কেল) এএসপি আনিসুর রহমান।