জঙ্গি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় সবদিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে: বিমান বাহিনী

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বলেছে, দেশের আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য রাজধানীতে বিমান ঘাঁটি থাকা ‘অত্যাবশ্যক’ এবং পৃথিবীর যে কোনো দেশের রাজধানীর জন্যই এটি ‘প্রযোজ্য’।
ঢাকার একটি স্কুলে বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার পর নানামুখি আলোচনার মধ্যে এ প্রতিক্রিয়া এল।

বিমানবাহিনীর বিমান পরিচালনা পরিদপ্তরের পরিচালক এয়ার কমডোর শহীদুল ইসলাম সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “রাজধানীর স্ট্র্যাটেজিক এবং অপারেশনাল নেসিসিটির সুবাদে এই দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা তথা রাজধানীর আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য রাজধানীতে জঙ্গি বিমানের ঘাঁটি থাকা অত্যাবশ্যক।”

গত ২১ জুলাই দুপুরে বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসের একটি ভবনের মুখে বিধ্বস্ত হয়। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই সামরিক বিমান দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত যে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই শিশু।
দগ্ধ ও আহত ৩৪ জন এখনো জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে, ১১ জন সিএমএইচে ও ১ জন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ওই ঘটনার পর নানা প্রশ্ন সামনে এসেছে। যে এফ-৭ বিজিআই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি নিরাপদ ছিল কি না, রাজধানীর মত জনবহুল জায়গায় জঙ্গি বিমানের প্রশিক্ষণ চলতে পারে কি-না, সে বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে।

ঘটনার এক সপ্তাহ পর বিমান বাহিনীর নানা কার্যক্রমের বিষয়ে জানাতে ঢাকার তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। সেখানেও তারা ওইসব প্রশ্নের মুখোমুখি হন।

জবাব দিতে গিয়ে এয়ার কমডোর শহীদুল ইসলাম বলেন, “যুদ্ধবিমান পরিচালনা, উড্ডয়ন এবং ল্যান্ড করার জন্য সুপরিসর রানওয়ে, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, মেনটেইনেন্স এবং লজিস্টিকস ফ্যাসিলিটিজ, ফুয়েল স্টোরেজ, রেডার ফ্যাসিলিটিজ এর সবগুলাই দরকার হয়।
“বিমান ঘাঁটিগুলো যেখানেই থাকুক, ফ্যাসিলিটিগুলো থাকতে হয়। কিন্তু অপারেশনাল এবং স্ট্র্যাটিজিক নেসিসিটির জন্য পৃথিবীর যে কোনো দেশের রাজধানীতে বিমানঘাঁটি অত্যাবশ্যক।”

তিনি বলেন, “জঙ্গি বিমানের স্কোয়াড্রনগুলোর প্রয়োজনীয় ট্রেনিং সারা বছরব্যপী চলমান থাকে। ওই অপারেশনাল বিমানগুলোতেই আমরা ট্রেনিং করে থাকি।”
প্রশিক্ষণ বিমানগুলোতে দুইজন পাইলট থাকেন এবং ‘সিঙ্গেল সিটার’ যুদ্ধ বিমানগুলোর ‘ক্যাপাসিটি এবং ক্যাপাবিলিটি সহই’ যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে এই কর্মকর্তার ভাষ্য।

মাইলস্টোনে বিধ্বস্ত হওয়া জঙ্গি বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের সঙ্গে আকাশে থাকা অবস্থায় যোগাযোগ ছিল কি-না জানতে চাইলে এয়ার কমডোর শহীদুল বলেন, “আমরা যখন বিমান উড্ডয়ন করি তখন আবশ্যিকভাবে বিমানের সাথে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, রেডার স্কোয়াড্রন এবং অন্যান্য কন্ট্রোলিং এজেন্সির সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকে।
“এই ক্ষেত্রেও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের সাথে একইভাবে সার্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ও যখন ল্যান্ড করার জন্য আসছিল, আমাদের সাথে পরিপূর্ণভাবে সংযোগ ছিল, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে।”

শেষ সময়ে তার সঙ্গে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কী কথা হয়েছিল, সে বিষয়েও সাংবাদিকরা জানতে চান।
বিমানবাহিনীর বিমান পরিচালনা পরিদপ্তরের পরিচালক বলেন, “এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একটি উচ্চ পদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তার সর্বশেষ অ্যাকশন কী ছিল এবং কোনো ধরনের জটিলতা ছিল কি না বা কোনো গোলযোগের সম্মুখীন হয়েছিল কি-না, এ বিষয়গুলো তদন্ত পরিষদে বিস্তারিত আসবে। আমরা তদন্ত চলাকালে কোনোরূপ আলাদা পর্যালোচনা বা মন্তব্য থেকে বিরত থাকব।”

পাইলট শেষ মুহূর্তে কোনো ধরনের জটিলতায় পড়েছিলেন কি-না, তিনি কোনো সাহায্য চেয়েছিলেন কি-না, এসব বিষয়ে তদন্ত চলাকালে কোনো মন্তব্য করতে চাননি এয়ার কমডোর শহীদুল।

বিধ্বস্ত হওয়ার আগে বিমানটি উচ্চতা হারায় বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। বিমানবন্দরের এত কাছে মাইলস্টোন ক্যাম্পাস এবং ভবনের উচ্চতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

বিমান বাহিনী জরুরি সমন্বয় কেন্দ্রের প্রধান সমন্বয়ক এয়ার কমডোর মো. মিজানুর রহমান উত্তরে বলেন, “আপনারা জানেন এখন অনেক কিছু অনুমান নির্ভর আসছে। বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত চলমান। প্রত্যেকটা বিষয় তদন্ত প্রক্রিয়ায় চলে আসবে।
“আমাদের একটাই কথা, আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন আসুক। মাইলস্টোনের বিষয়টিও তদন্তে আসবে, জাতীয় পর্যায়েও একটা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটা বিষয় আমাদের তদন্তে নিয়ে আসব। কোনো একটা বিষয় আমরা বাদ দেব না।”

বিমান বাহিনী সোমবার মাইলস্টোনে অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করেছে। যেখানে একজন মনোবিজ্ঞানী, একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন এবং তারা নিয়মিত সেখানে কাজ করবেন বলে জানান এয়ার কমডোর মিজানুর।

বিধ্বস্ত এফ-৭ বিজিআই বিমানটি চীনের তৈরি। সে কারণে তদন্তে সহায়তার জন্য চীনের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান বিমান বাহিনী জরুরি সমন্বয় কেন্দ্রের প্রধান।
তিনি বলেন, “তদন্তে আন্তর্জাতিক সহায়তা দুর্ঘটনার মূল কারণ চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে।”

এয়ার কমডোর মিজানুর বলেন, ঘটনার দিন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী উদ্ধারকার্যে অংশগ্রহণ করে এবং একই দিনে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
“পরবর্তিতে, বিমানবাহিনী প্রধানের দিক নির্দেশনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসকল কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদনের জন্য গত ২১ জুলাই ‘জরুরি সহায়তা কেন্দ্র’ গঠন করা হয়।”

জরুরি সহায়তা কেন্দ্র থেকে আহতদের চিকিৎসা, আহতদের অবস্থান ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত তথ্য, নিহতদের পরিচয় যাচাই ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ, নিহতদের দাফন ও সৎকার কার্যক্রম সমন্বয়, হাসপাতালে রক্তদাতা প্রেরণ এবং সংগ্রহে সহায়তা, এবং যে কোনো জরুরি তথ্য, পরামর্শ ইত্যাদি সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

এয়ার কমডোর মিজানুর বলেন, সকল নিহত ও আহতদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বিমান বাহিনী। যতদিন প্রয়োজন হয় ততদিন সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ দিয়াবাড়ি শাখার অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর খাঁন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “দুর্ঘটনার পরে আমাদের কাজ ছিল ইমিডিয়েট আমাদের ছাত্রদের খোঁজ নেওয়া। যারা হারিয়ে গেছে, অভিভাবকের কাছে পৌঁছেছে কি না। সিসি ফুটেজ নিয়ে ওইসময় নাড়াচাড়া করার কোনো অবকাশ ছিল না। আর ওই মূহুর্তে এটা আমাদের প্রায়োরিটি ছিল না।”

ওই ভবনে ৭৩৮ জন শিক্ষার্থী আসা-যাওয়া করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের প্রথম কাজ ছিল এই ৭৩৮ জন অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করা। সিসিটিভি ফুটেজটা দেখে ওই মূহুর্তে কী কাজে আসবে?”

অধ্যক্ষ বলেন, প্রতিদিন ৮০-৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত থাকে। সে হিসেবে সেদিন ভবনটিতে প্রায় ৫৯০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
ভবনটি গ্রিল দিয়ে ঘেরা কেন, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ছোট বাচ্চারা ক্লাস করে বলেই ওখানে গ্রিল দেওয়া।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর খাঁন বলেন, “মাইলস্টোন ছাড়াও সেখানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। মাইলস্টোন আলাদা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজউকের নিয়ম ও বেবিচকের আইন মেনেই ভবনটি করা হয়েছে।”
মেট্রোরেলের ভবন মাইলস্টোনের ভবনের চেয়ে উঁচু মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পুরো এলাকাতেই আমাদের চাইতে উঁচু ভবন আছে। পুরো এলাকাতেই হাইরাইজ ভবন দিয়ে ঢাকা। সমস্ত অনুমোদন নিয়েই নির্মাণ কাজ করা হয়েছে।”