জন্মসূত্রে ভারতীয় নন জানার পর রাষ্ট্রহীন হলেন তামিলনাড়ুর ওয়েব ডেভেলপার বাহিসন রবীন্দ্রন

দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে শ্রীলঙ্কান শরণার্থী বাবা-মায়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া ৩৪ বছর বয়সী ওয়েব ডেভেলপার বাহিসন রবীন্দ্রন সবসময়ই নিজেকে ভারতীয় ভেবেছেন। সেখানেই পড়াশোনা ও চাকরি করেছেন তিনি। হাতে পেয়েছেন ভারতের সরকারি বিভিন্ন পরিচয়পত্র, এমনকি ভারতীয় পাসপোর্টও। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে হঠাৎ করেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে জানায়, তার পাসপোর্ট অবৈধ।

কারণ, আইনের চোখে তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক নন। ১৯৯০ সালে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময় তার মা-বাবা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুই জনই শ্রীলঙ্কান হওয়ায় রবীন্দ্রনও জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাননি।

একসময় ভারতের আইনে দেশটিতে জন্ম নিলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যেত। কিন্তু ১৯৮৭ সালে আইন সংশোধনের পর থেকে ১ জুলাইয়ের পর জন্ম নেওয়া কোনও শিশুর বাবা বা মায়ের অন্তত একজন ভারতীয় নাগরিক না হলে সেই শিশু নাগরিকত্ব পায় না। রবীন্দ্রনের জন্ম ১৯৯১ সালে, বাবা-মায়ের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কয়েক মাস পর।

গত সপ্তাহে চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ হাইকোর্টে রবীন্দ্রন জানান, এই নিয়ম তিনি জানতেন না; তবে নিজের শ্রীলঙ্কান বংশপরিচয় কখনও গোপন করেননি। নিয়মটি জানার পর তিনি প্রাকৃতিকীকরণ (ন্যাচারালাইজেশন) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু ততদিনে তিনি হয়ে গেছেন ‘রাষ্ট্রহীন’।

তার ঘটনা নতুন করে সামনে এনেছে তামিল শরণার্থীদের দীর্ঘদিনের দুরবস্থা। ১৯৮০’র দশকে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময় পালিয়ে আসা ৯০ হাজারের বেশি শরণার্থী এখনও তামিলনাড়ুতে শিবিরে ও শিবিরের বাইরে বসবাস করছে। তাদের সন্তানদের মধ্যে রবীন্দ্রনের মতো ২২ হাজারের বেশি মানুষের জন্ম হয়েছে ১৯৮৭ সালের পর শ্রীলঙ্কান তামিল বাবা-মায়ের পরিবারে। কিন্তু দশকের পর দশক পেরিয়েও তাদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন ঝুলে আছে।

ভারত ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের প্রোটোকলে সই করেনি। ফলে শ্রীলঙ্কান শরণার্থীদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবেই গণ্য করা হয়। অন্যদিকে, ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে নির্যাতিত অমুসলিম সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব সহজ করলেও শ্রীলঙ্কান তামিলদের বাইরে রেখেছে।

তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে শ্রীলঙ্কান তামিলদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন বহুদিন ধরেই ভাবাবেগের বিষয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেও বেশিরভাগের জন্য তা অধরাই রয়ে গেছে। ভারত প্রথমবার কোনও শ্রীলঙ্কান তামিলকে নাগরিকত্ব দেয় ২০২২ সালে—কেএ নলিনী নামে এক নারীকে, যিনি ১৯৮৭ সালের আইন কার্যকর হওয়ার এক বছর আগে জন্মেছিলেন। এরপর থেকে আরও অন্তত ১৩ জন তামিলকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে।

রবীন্দ্রন চান তার নাগরিকত্বের আবেদনও দ্রুত গ্রহণ করা হোক। তার দাবি, তিনি সবসময়ই ভারতের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন এবং শ্রীলঙ্কায় ফেরার কোনও ইচ্ছা তার নেই। তিনি বলেন, প্রথমবার শুনেছিলেন যে তিনি রাষ্ট্রহীন—তা মেনে নিতে পারেননি।

গত বছর সেপ্টেম্বরে বিয়ের জন্য একবারই শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন রবীন্দ্রন। সেখানে তার বিয়ে হয় এক শ্রীলঙ্কান নারীর সঙ্গে। পরে স্ত্রীকে পাসপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে নতুন করে আবেদন করার পরই তার সমস্যার শুরু হয়।

তার আইনজীবী সন্দেশ সরাভানন জানান, পুলিশ যাচাই করেই তাকে নতুন পাসপোর্ট দিয়েছিল এবং তারা তার শ্রীলঙ্কান বংশপরিচয় জানত। কিন্তু পরে ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (এফআরআরও) রবীন্দ্রনের বাবা-মায়ের শ্রীলঙ্কান পরিচয় শনাক্ত করে পুলিশকে জানায়। এরপর প্রতারণা, জালিয়াতি ও অবৈধভাবে ভারতীয় পাসপোর্ট রাখার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। টানা ১৫ দিন পুলিশ হেফাজতে থাকার পর তিনি জামিনে মুক্ত হন।

ভবিষ্যতে আবারও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখে পড়তে পারেন আশঙ্কায় রবীন্দ্রন গত সপ্তাহে মাদ্রাজ হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। আদালত আগামী ৮ অক্টোবরের শুনানি পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে তার বিরুদ্ধে কোনও কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

“এত বছর ধরে কেউ আমাকে বলেনি যে, আমি ভারতীয় নই। প্রথমবার যখন শুনলাম আমি রাষ্ট্রহীন, তখন মেনে নিতে পারিনি,” বলেন রবীন্দ্রন।