অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার বাস্তবায়ন ও নদী রক্ষা নিয়ে আলোচনা

অর্থনীতিবিদ সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সংস্কার প্রসঙ্গে এত বেশি আলোচনা হয়েছে, যা বিগত ৫৪ বছরে দেখা যায়নি। তবে সংস্কার ঠিক কোন জায়গায় এবং কীভাবে হবে, তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়।

আজ শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এই মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার আয়োজন করেছে নোঙর ট্রাস্ট। সহযোগিতা করেছে ওয়াটার কিপার বাংলাদেশ, রিভারাইন পিপল, রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি), বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), তুরাগ নদী সুরক্ষা কমিটি এবং নদী রক্ষা জোট।

সংস্কার প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “সংস্কারটা ঠিক কোন জায়গায়, কীভাবে হবে, সেটা আমরা এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখিনি। একমাত্র সংবিধান নিয়ে সংস্কারের কিছু সুনির্দিষ্ট আলোচনা দেখা যায়। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে প্রকৃত উদ্যোগ দেখা যায়নি। নদী নিয়ে কোনো সংস্কার কমিশনও হয়নি। অথচ নদী আমাদের অস্তিত্বের অংশ, এবং অস্তিত্বও থাকবে না যদি নদী না থাকে।”

তিনি অভিযোগ করেন, সরকার নদী নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তিনি বলেন, সরকারের একটি সহজ কাজ ছিল নদী নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের সংযুক্ত করা এবং ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করা। কিন্তু সরকার এসব করতে পারেনি। তিনি মনে করেন, যেহেতু ভারত এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি, তাই বাংলাদেশকে এগুলো করা উচিত।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, নদীর পানিবণ্টনে ভারত কখনো বহুপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নিতে চায় না। দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও বাংলাদেশ পূর্বে তেমন লাভবান হয়নি। সমুদ্রসীমানা নির্ধারণে বাংলাদেশের সাফল্যও আন্তর্জাতিক আইনের সহায়তায় এসেছে। তাই নদীর পানির ন্যায্যতা আদায়ে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার শিকার ভারতের জনগণ। ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করেছিলেন ভারতের বিশেষজ্ঞরা, এবং এখন ফারাক্কা বাঁধ ভাঙার আওয়াজ উঠেছে। ভারতের বিভিন্ন বাঁধবিরোধী মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংহতি ও যোগাযোগ বজায় রাখা এবং ভারতের শাসক শ্রেণির ওপর চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

নদী বিপর্যয়ের তিনটি কারণ

বাংলাদেশে নদী বিপর্যয়ের জন্য তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ: ভারতের নদী আগ্রাসন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদী বিধ্বংসী উন্নয়ন প্রকল্প এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দখল ও দূষণ। তিনি বলেন, “যদি জলবায়ু পরিবর্তন না হয়, তবুও দেশের ভেতরে ক্ষমতাবানদের জন্য নদী বিনাশী প্রকল্প গ্রহণ হয়েছে।”

জাতীয় নদী দিবস ও নদীসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রস্তাবনা

আলোচনা সভায় নোঙর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস নদী রক্ষায় ধারণাপত্র ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নদী রক্ষায় ২৩ মে জাতীয় নদী দিবস ঘোষণা এবং নদীসম্পদ মন্ত্রণালয় গঠন করা প্রয়োজন। সমন্বয়হীনতা, দখল ও দূষণ রোধ, আন্তর্জাতিক পানিবণ্টন চুক্তি কার্যকর করা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এ ধরনের মন্ত্রণালয় জরুরি।

৪০ নদী নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, নদীর পানিবণ্টনে ভারত নৈতিকতার জায়গায় নেই। তিনি দাবি করেন, অভিন্ন নদীর সংখ্যা সরকারিভাবে ৫৪টি হলেও তিনি সরেজমিনে ২১৫টি নদীর খোঁজ পেয়েছেন। এর মধ্যে ৪০টি নদীর পানি বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছে বা ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এই ৪০টি নদী নিয়ে বাংলাদেশ চাইলে ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তবে নদীর ওপরে কোনো স্থাপনা করা উচিত নয়।

পরিবেশবিদ ও মানবাধিকারকর্মী শরীফ জামিল বলেন, অভিন্ন নদীর ওপর কাজ করতে হলে অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন। সভ্য সমাজে আলোচনা ছাড়া কোনো পরিকল্পনা করা যায় না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া মুঠোফোনে যুক্ত হয়ে বলেন, “প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নদীর সংখ্যা নির্ধারণ করা। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সুন্দরবনের নদীর সংখ্যা জানা প্রয়োজন।”

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের যুগ্ম পরিচালক শর্মিলা খানম বলেন, নদীতে ২.৫ মিটার নাব্যতা রাখার বিধান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীতে বাস্তবে ১ মিটারও নাব্যতা নেই। এই পরিস্থিতি রোধে সব মহলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন নদী গবেষক ও লেখক আইরিন সুলতানা, অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার, নদী ও নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার নজীর আহমদ, হাওর অঞ্চলবাসীর আহ্বায়ক জাকিয়া শিশির এবং রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন।