ইসরায়েলের নৌপ্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ও গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে গত ৩১ আগস্ট স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। এ নৌবহরে প্রায় ৫০টি জাহাজ ছিল। এসব জাহাজে মানবাধিকারকর্মীসহ প্রায় ৪৪টি দেশের সাড়ে চারশ প্রতিনিধির অংশগ্রহণ ছিল।
নৌবহলের কিছু জাহাজ ইসরায়েল আটক করে বুধবার; বাকিগুলো আটক করা হয় বৃহস্পতিবার। প্রায় সবগুলো জাহাজই আটক করা হয় আন্তর্জাতিক জলসীমা ও ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক জলসীমা থেকে। এ ঘটনায় উঠেছে এক মৌলিক প্রশ্ন — ইসরায়েল কি চাইলেই আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক জলসীমায় থাকা কোনো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে?
উত্তর হলো— পারে না। কেন পারে না, সেই ব্যাখ্যা এক প্রতিবেদনে খোঁজা হয়েছে।
উপকূলীয় দেশগুলো তাদের উপকূল থেকে নিকটবর্তী একটা এলাকা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেটাকে ‘আঞ্চলিক জলসীমা’ বলা হয়। এই জলসীমা উপকূল থেকে ন্যূনতম ১২ নটিক্যাল মাইল (২২ কিলোমিটার) পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই আঞ্চলিক জলসীমায় একটি দেশ নিজেদের স্থলভূমির মতো পূর্ণ সার্বভৌমত্ব পায়।
এর বাইরে অন্তত ২০০ নটিক্যাল মাইল (৩৭০ কিলোমিটার) পর্যন্ত অধিকার পাওয়া যায়, যেটাকে ‘একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল’ (ইইজেড) বলা হয়। এই জলসীমায় মাছ শিকার, খনিজ পদার্থ সংগ্রহ ও ড্রিলিং করার পাশাপাশি জ্বালানি বিষয়ক প্রকল্পও হাতে নেওয়া যায়। তবে এই অঞ্চলে অন্যান্য দেশের নৌযান চলাচলের স্বাধীনতা থাকে।
বিশ্বে সবচেয়ে বড় ইইজেড রয়েছে ফ্রান্সের; এটি প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার (৪২ লাখ বর্গমাইল) জুড়ে। তালিকায় ফ্রান্সের পরে রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য।
আটক হওয়ার আগে লাইভ ট্র্যাকারে গাজার জলসীমায় সুমুদ ফ্লোটিলার অবস্থানের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছিল।
সমুদ্রের প্রায় ৬৪ শতাংশ অংশই আন্তর্জাতিক জলসীমার অন্তর্ভুক্ত। কোনো দেশের আঞ্চলিক জলসীমা ও একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের পর থেকেই আন্তর্জাতিক জলসীমা শুরু হয়। এটি একক কোনো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি মোতাবেক এই এলাকা ব্যবহৃত হয়।
আন্তর্জাতিক জলসীমার আইন কী বলে— এ নিয়ে বলা হয়, এই জলসীমা ১৮৮২ সালের জাতিসংঘের সমুদ্র আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই আইনের আলোকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় যেকোনো দেশ নৌযান চালাতে পারে; এ জলসীমার ওপর দিয়ে বিমান চলাচলের স্বাধীনতাও রয়েছে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় সাবমেরিন ক্যাবল ও পাইপলাইন বসানোর পাশাপাশি মাছ শিকার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণের অনুমতিও আছে, তবে এগুলোকে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইনের আলোকে করতে হবে।
এই জলসীমায় চলাচল করা জাহাজে যে রাষ্ট্রের পতাকা থাকবে, সেই জাহাজে ওই রাষ্ট্রেরই কর্তৃত্ব বিবেচিত হবে। তবে জলদস্যুতা বা বেআইনি কর্মকাণ্ড হলে সেই কর্তৃত্ব থাকবে না; সে ক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
ইসরায়েল আগেও আন্তর্জাতিক জলসীমায় হামলা চালিয়েছে — ২০১০ সাল থেকে একাধিক ফ্লোটিলা গাজার ব্লকেড ভাঙার চেষ্টা করেছে এবং প্রতিবারই সেগুলো ইসরায়েলের হামলার মুখে পড়েছে; অধিকাংশ হামলা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ঘটেছে, যেখানে ইসরায়েলের আঞ্চলিক অধিকার নেই। সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা ঘটে ২০১০ সালের ৩১ মে, যখন আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলের কমান্ডো বাহিনী মাভি মারমারায় অভিযান চালায়; ওই হানায় ১০ মানবাধিকারকর্মী নিহত হন এবং কয়েক ডজন আহত হন; হতাহতদের অধিকাংশই তুরস্কের নাগরিক ছিলেন। এ ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা যে পথ ধরে যাচ্ছিল, সেটি আন্তর্জাতিক ও ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক জলসীমার মধ্যে পড়ে। এই পথে নৌযান চলাচল বা ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার আইনি অধিকার রয়েছে— এমনটাই বলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের (আইটিএফ) সাধারণ সম্পাদক স্টিফেন কটন মন্তব্য করেছেন: “সমুদ্র আইন খুবই স্পষ্ট— আন্তর্জাতিক জলসীমায় অহিংস ও মানবিক কাজে ব্যবহৃত কোনো নৌযানে হামলা কিংবা সেটা জব্দ করাটা বেআইনি; অগ্রহণযোগ্যও।”