শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে দুই মামলা

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিরোধী মতের লোকদের গুমের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।

দুই মামলাতেই প্রধান আসামি করা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দুটি দাখিল করা হয় বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম।

প্রথম মামলায় র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশনের (টিএফআই) গোপন সেলে বিরোধী মতাবলম্বীদের গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলায় শেখ হাসিনা, তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট পাঁচটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।

আরেক মামলায় ডিজিএফআইয়ের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে শেখ হাসিনা, তারিক সিদ্দিকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে। এ মামলাতেও মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনের সময় ঢাকার রামপুরায় গুলি করে হত্যার ঘটনায় বিজিবি কর্মকর্তাসহ চার জনের বিরুদ্ধে আরেকটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছে প্রসিকিউশন, যেখানে মোট ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বহু বিরোধী মতাবলম্বীকে তুলে নিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে আটক রাখার অভিযোগ ওঠে। এসব গোপন বন্দিশালার প্রতীকী নাম ছিল ‘আয়নাঘর’।

এই ঘটনাগুলোর তদন্তে গতবছর অগাস্টে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে সরকার।

গত ডিসেম্বরে জমা দেওয়া কমিশনের প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই প্রতিবেদনে হাসিনা প্রশাসনের আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার কথাও উল্লেখ করা হয়—যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান, এবং পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও হারুন অর রশীদ।

গত ৪ জুন কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশ, র‌্যাব, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে ‘মূল অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তর (এনএসআই) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তাদের জড়িত থাকারও সত্যতা পাওয়া গেছে। ডিজিএফআই বিভিন্ন ‘ব্ল্যাক সাইট’ পরিচালনা করত বলে অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল ‘আয়নাঘর’, যেখানে বন্দিদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রেখে চরম নির্যাতন চালানো হতো।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাত তিনটি গোপন বন্দিশালা ঘুরে দেখেন।
গত সরকারের সময় গোপন বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহৃত এই কক্ষের দেয়ালে ছোট ছোট দাগ কেটে রাখা হয়েছে, হয়ত কোনো বন্দি সেটা করেছেন দিন গোনার জন্য। ছবি: পিআইডি

গত ৩ জুলাই সেনা সদরের এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য ডেপুটেশনে থাকেন, তারা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকেন না। ডেপুটেশনে থাকা কিছু সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, যার তদন্ত চলছে।

তিনি বলেন, “তদন্তে যদি গুমের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, সেনাবাহিনী অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব ধরনের সহযোগিতা করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।”

গুমের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন করার প্রস্তাবে ইতোমধ্যে সম্মতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

গত ২৫ অগাস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। খসড়ায় গুমকে সংজ্ঞায়িত করে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া গোপন আটককেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবহারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে গুম সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।