সারাদেশে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকার আজিমপুরে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা কেন্দ্রে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
তিনি বলেন, “টাইফয়েডে এখনও দেশের শিশুদের মৃত্যু হয়— এটা লজ্জার। বাংলাদেশ ডায়রিয়া, রাতকানাসহ অনেক রোগ প্রতিরোধ করেছে। এবার টাইফয়েড প্রতিরোধেও সফল হবে। টাইফয়েড এমন একটি রোগ, যা সচেতনতা ও টিকাদানের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা যদি প্রতিটি শিশুর কাছে টিকা পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে দেশে টাইফয়েডে মৃত্যুর ঘটনা কার্যত বন্ধ করা সম্ভব হবে। এ উদ্যোগ আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।”
রোগ প্রতিরোধ করতে পারলে স্বাস্থ্যের ওপর চাপ কমানো যায় উল্লেখ করে নূরজাহান বেগম আরও বলেন, “আমাদের এখন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য রোগ প্রতিরোধ। যত বেশি মানুষ, বিশেষ করে শিশুদের প্রতিরোধমূলক টিকার আওতায় আনা যাবে, ততই হাসপাতালে ভিড় ও চাপ কমবে।”
দেশের প্রথমবারের জাতীয়ভাবে টাইফয়েড কর্মসূচির আওতায় ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী প্রায় পাঁচ কোটি শিশুকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে ১৮ কর্মদিবস টিকাদান কর্মসূচি চলবে। প্রথম ১০ কর্মদিবস বিভিন্ন বিদ্যালয়ে এবং পরের আট কর্মদিবস টিকাদান কেন্দ্রে দেওয়া হবে এই টিকা। এ কর্মসূচির আওতায় এক ডোজ ইনজেক্টেবল টিকা শিশুদের দেওয়া হচ্ছে। এ কর্মসূচিতে সহায়তা করছে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন সহায়তা সংস্থা গ্যাভি।
অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, “টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি শুধু একটি প্রকল্প নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই কর্মসূচি আমাদের শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। দীর্ঘদিন ধরে টাইফয়েড একটি নীরব বিপদ হিসেবে থেকে গেছে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুদের জন্য। এবার সরকারের এই উদ্যোগ সেই দুর্বল জায়গায় বড় পরিবর্তন আনবে। আমি আশা করি, সবাই সচেতনভাবে অংশ নেবে এবং তাদের সন্তানদের টিকা নিশ্চিত করবে।”
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে টাইফয়েড টিকার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ স্টাডি অনুযায়ী ২০২১ সালে বিশ্বে ৭০ লাখের বেশি মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যু হয় ৯৩ হাজার মানুষের। মৃতদের একটি বড় অংশ দক্ষিণ এশিয়ায়। এ সময় বাংলাদেশে প্রায় আট হাজার মানুষ টাইফয়েড জ্বরে মারা যায়। এর ৬৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ছয় হাজার জনের বয়স ছিল ১৫ বছরের কম।
তিনি আরও বলেন, “টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসায় প্রচলিত যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়, তার একটি বড় অংশ কাজ করছে না। ফলে ভয়াবহ ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড জ্বরের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। টাইফয়েড টিকা নিলে এই জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেকাংশে কমে যাবে। এতে অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ কমে আসবে। এছাড়া শিশুদের টাইফয়েড সংক্রমণজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুহার বহুলাংশে কমাবে।”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার সভাপতি আজমল হোসেন। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, ইউনিসেফের কান্ট্রি ডিরেক্টর রানা ফ্লাওয়ার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ডা. আহমদেম জামশেদ মোহাম্মদ।
নিবন্ধন প্রক্রিয়া
টাইফয়েডের টিকাদানের জন্য ১ অগাস্ট থেকে অনলাইনে নিবন্ধন শুরু হয়েছে। এজন্য vaxepi.gov.bd/registration/tcv ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে। নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজন হবে ১৭ সংখ্যার জন্ম নিবন্ধন সনদ। এরপর নারী না পুরুষ সেই ঘরটি পূরণ করতে হবে। একটি ক্যাপচা কোড পূরণের মাধ্যমে আবেদনকারীর সব তথ্য যাচাই করে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে।
এই অংশে গিয়ে আবেদনকারী বা পিতা-মাতার মোবাইল নম্বর, ই-মেইল, পাসপোর্ট নম্বর ও বর্তমান ঠিকানার ঘর পূরণ করে সাবমিট করতে হবে। সাবমিট করার পর মোবাইল ফোনে আসা একটি ওটিপি দেওয়ার মাধ্যমে নিবন্ধনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ হবে।
দ্বিতীয় ধাপে টাইফয়েড অথবা মেনিনজাইটিস এই দুটির একটি সিলেক্ট করতে হবে। টাইফয়েড অংশে ক্লিক করলে দুটি অপশন আসবে— শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত নবম শ্রেণি ও সমমান পর্যন্ত শিক্ষার্থী অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপশন বেছে নিলে প্রতিষ্ঠানের নাম, পুরো ঠিকানা ও শ্রেণির তথ্য পূরণ করতে হবে। এরপর সাবমিট করলে টিকাদান কেন্দ্রের তথ্য পাওয়া যাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত শিশুদের ক্ষেত্রে টিকাদান কেন্দ্র বাছাইয়ের পর সাবমিট করলে ভ্যাকসিন কার্ড পাওয়া যাবে। এই কার্ড ডাউনলোড করে নির্ধারিত দিনে টিকাদান কেন্দ্রে যেতে হবে।
টিকা দেওয়ার পর অনলাইনেই পাওয়া যাবে টাইফয়েড ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট। জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকলেও বাবা-মায়ের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে নিবন্ধন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে লিখিতভাবে টিকার তথ্য দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি।