জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং তা সাশ্রয়ী রাখা নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনীতি সচল রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, ‘বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে নীতিগতভাবে আমরা বিদ্যুতের মূল্য আপাতত না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
বাজেট বক্তৃতায় তিনি আরও জানান, বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ, যা অনেক বেশি। এই ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যাতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনার কাজ চলমান রয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে দেশের জ্বালানি সরবরাহ সংকটে থাকলেও বাজেট বরাদ্দে এই খাতটি উপেক্ষিত ছিল। পূর্ববর্তী সরকার আমদানির ওপর নির্ভর করেছে, অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেয়নি। তবে এবার অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়েছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকায়। প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে উন্নয়ন বরাদ্দ ২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা।
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার নিজস্ব উদ্যোগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৭-২৮ অর্থবছরের মধ্যে বাপেক্সের মাধ্যমে ২৭০ কিলোমিটার ভূতাত্ত্বিক জরিপ, ৭০০ কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক ও ৭০০ কিলোমিটার ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি নিজস্ব রিগ ব্যবহার করে ৬৯টি কূপ খনন এবং ৩১টি কূপ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ব্যয় সাশ্রয়ী ও টেকসই অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। ৩০ লাখ টন অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের জন্য ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ইআরএল-২ স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে চলতি বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমে ২১ হাজার ৬৫১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন বরাদ্দ ২০ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা।
বিতরণব্যবস্থা আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে মেট্রোপলিটন এলাকায় বিতরণ লাইন ও সাবস্টেশনগুলো ভূগর্ভস্থ করার কাজ চলমান রয়েছে, যা বিতরণব্যবস্থাকে আরও স্থিতিশীল করবে। নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ সাশ্রয়ী দামে আমদানি করা হবে এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ডিসেম্বরে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০০৮ হালনাগাদ করে নতুন নীতিমালা তৈরির কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ২০৪০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৩০ শতাংশ এবং ২০২৮ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পরিচ্ছন্ন উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
এলএনজি আমদানিতে বর্তমানে দুই ধাপে শুল্ক দিতে হয় পেট্রোবাংলাকে। এবার আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে আমদানি খরচ কমে। জ্বালানি তেলে শুল্ক নির্ধারিত মূল্যের পরিবর্তে কেনা দামের ভিত্তিতে আদায়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা বিপিসির খরচ কিছুটা বাড়াতে পারে। তবে শুল্কহার কমিয়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেলের শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে সামগ্রিক শুল্ক আদায়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না।
বেসরকারি খাতের ক্ষেত্রে আমদানি খরচ কমবে, কারণ তারা আগে থেকেই কেনা দামে শুল্ক দিয়ে থাকে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব-এর জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম না বাড়ানো ও এলএনজির শুল্ক প্রত্যাহার একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে জ্বালানি তেল থেকে রাজস্ব আদায় যাতে না বাড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বরাদ্দ বাড়ানো হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে তা যথেষ্ট নয় এবং জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিতে বাজেটে স্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে।