চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানি: দায়িত্ব পাচ্ছে নৌবাহিনী, পরে ডিপি ওয়ার্ল্ড?

বিভিন্ন মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে সরকার।

বর্তমানে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে সরকারের চুক্তি শিগগিরই শেষ হচ্ছে। এরপর ছয় মাসের জন্য টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পাবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এ সময়ের মধ্যেই সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে আলোচনা চলবে এবং পরবর্তীতে তারাই বা অন্য কোনো বিদেশি কোম্পানি স্থায়ীভাবে দায়িত্ব নিতে পারে।

বুধবার সচিবালয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।

এর আগের দিন অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বন্দর পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠান নিয়োগে বন্দর কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নৌবাহিনীকে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য এনসিটির দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

উপদেষ্টা বলেন, “আমরা নেভিকে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছি। সেজন্য তারা নেভির সঙ্গে চুক্তি করছেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন যে কোনো সময় চাইলে অপারেটর নিয়োগ করতে পারবে।”

তিনি জানান, সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের পর তাদের চুক্তির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়েছিল, যা ৬ জুলাই শেষ হচ্ছে। এরপর আর এক্সটেনশন দেওয়া হচ্ছে না।

“পাঁচ মাসের জন্য ওপেন টেন্ডার করা সময়সাপেক্ষ বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেই ছয় মাস পরিচালনা করবে। এ সময় নেভিকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাদের টেকনিক্যাল জ্ঞান রয়েছে,” বলেন উপদেষ্টা।

নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল এরশাদকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

সাইফ পাওয়ারটেকের কর্মীদেরও কাজে লাগানোর কথা জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “১৬ বছর ধরে একটি কোম্পানি কাজ করছে। তাদের অভিজ্ঞতা নৌবাহিনী কাজে লাগাবে। বন্দর থেকে কোনো কর্মী ছাঁটাই হবে না।”

বিদেশি কোম্পানি বিষয়ে তিনি বলেন, “বিদেশি অপারেটর নিয়ে আসা মানেই পোর্ট দিয়ে দেওয়া নয়। ডিপি ওয়ার্ল্ড যদি বিনিয়োগ করে, তাহলে অপারেটর হিসেবে কাজ করবে। মালিকানা থাকবে বন্দরের কাছেই।”

তিনি আরও বলেন, “ডিপি ওয়ার্ল্ড বিশ্বের ৮৫টি আন্তর্জাতিক বন্দর পরিচালনা করছে। তারা বড় ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে আসবে, নতুন ইক্যুইপমেন্ট দেবে। যেমন—দুইটি কনটেইনার একসাথে নামানোর মতো ক্রেন আনছে। এজন্য রেল ট্র্যাকও রূপান্তর করতে হবে। এসব বিনিয়োগ করবে তারাই।”

উপদেষ্টা বলেন, “তারা বলেছে, বাইরের দেশ থেকে লোক আনবে না। বাংলাদেশ থেকেই লোক প্রশিক্ষণ দিয়ে নেবে।”

ডিপি ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলেও মন্তব্য করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “দুবাইতে আমাদের ১৪ লাখ লোক আছে। ডিপি ওয়ার্ল্ড এখান থেকে আরও ৪০০ ইঞ্জিনিয়ার নেবে।”

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, “অপারেশন ডিপি ওয়ার্ল্ড চালালেও মালিকানা বন্দরের কাছেই থাকবে।”

তিনি বলেন, “তাদের মতো কোম্পানি আসলে আধুনিক জাহাজ আসবে, টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম কমবে, নতুন রুট তৈরি হবে। এখন আমাদের কন্টেইনার ভাড়া উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি। সেটা এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।”

তিনি আরও জানান, “এখন প্রতিদিন ৪,৫০০ থেকে ৫,০০০ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডেল হয়। ভবিষ্যতে তা ৬,০০০ ছাড়িয়ে যাবে। অপারেশন দক্ষতা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে।”

চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কন্টেইনার টার্মিনালের মধ্যে এনসিটি সবচেয়ে বড়। ২০২৪ সালে এখানেই মোট কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৪৪ শতাংশ হয়েছে।

এনসিটি নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং শেষ হয় ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে। খরচ হয়েছিল ৪৬৯ কোটি টাকা।

২০১৫ সালের ২৫ জুন এনসিটির ৪ ও ৫ নম্বর জেটি পরিচালনার জন্য চুক্তি করে সাইফ পাওয়ারটেক ও তাদের অংশীদাররা। একই বছরের সেপ্টেম্বরে ২ ও ৩ নম্বর জেটির চুক্তি হয়।

দরপত্রের মাধ্যমে দুই বছরের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হলেও পরে ১১ বার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পায় সাইফ পাওয়ারটেক। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আরও ছয় মাসের মেয়াদ বাড়ানো হয়।

এনসিটিতে বছরে ১০ লাখ একক কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে। ২০২৪ সালে দেশি অপারেটর ১২ লাখ ৮১ হাজার ইউনিট হ্যান্ডল করেছে।

বিদেশি অপারেটর নিয়ে আসার প্রক্রিয়া নিয়ে অতীতে বেশ কয়েকবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও বিভিন্ন আইনি জটিলতায় তা কার্যকর হয়নি।

বিদেশি অপারেটর আনার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অবস্থান স্পষ্ট হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতা শুরু হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিক দল, বাম সংগঠন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিদেশি অপারেটর নিয়োগের বিরোধিতা করেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করা, রাখাইনে মানবিক করিডোর এবং স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা চালুর বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ২৭ ও ২৮ জুন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোড মার্চ করে কিছু বাম সংগঠন।

তবে বন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি খণ্ডন করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, “আমরা যাদের আনছি, তারা যে দেশেই কাজ করেছে, কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব বা নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েনি।”