ঢাকা: দুর্গাপূজা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ২২ বিশিষ্ট নাগরিক। বুধবার এক যৌথ বিবৃতি দিয়ে তাঁরা এ মন্তব্য প্রত্যাহার ও ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়েছেন। ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের পক্ষে এ বিবৃতি প্রদান করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, “এবার দুর্গাপূজা নিয়ে মদ-গাঁজার আসর বসানো যাবে না।” এই বক্তব্য কেবল একটি সুপ্রাচীন, সর্বজনীন ধর্মীয় উৎসবের ভাবগাম্ভীর্য ও পবিত্রতাকে ক্ষুণ্ন করেনি; বরং শিশু, নতুন প্রজন্ম ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দুর্গাপূজাকে মাদক ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করে এক বৈষম্যমূলক ও বিভ্রান্তিকর বার্তা দিয়েছে। এটি সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের পাশাপাশি বাংলাদেশের দীর্ঘকালীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বিবৃতিদাতারা বলেছেন, দুর্গোৎসব সনাতন হিন্দুদের ধর্মীয় পূজা হলেও বাস্তবে এটি সমাজের সব ধর্ম-বর্ণ-পেশার মানুষের মিলনমেলা এবং অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির অনন্য উদাহরণ। এই পূজাকে ‘মদ-গাঁজা’ দিয়ে কলঙ্কিত করে মিথ্যা বানোয়াট উসকানিমূলক তথ্য ছড়িয়ে কোনো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিশৃঙ্খলা তৈরি করা যাবে না।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দুর্গাপূজাসহ হিন্দু এবং দেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর পূজা, অনুষ্ঠান, উৎসব ও ধর্মস্থলে নানা সময়ে হামলা, আক্রমণ, ভাঙচুর, নিপীড়ন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেশের হিন্দুসহ সব জনগণের অবদান ও অংশগ্রহণ রয়েছে। কোনোরকম উসকানি বা মব সন্ত্রাসকে জায়েজ করে ধর্মসহ হিন্দুদের সামগ্রিক জীবনের ওপর কোনো বৈষম্য, নিপীড়ন, বর্ণবাদ এবং অপমান দেশের সংবিধান, আইন ও জনসংস্কৃতিবিরোধী।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরও দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিশ্বাস, চর্চা, স্থাপনা, প্রার্থনাস্থল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা হয়েছে। এমনকি মদ ও গাঁজার প্রমাণহীন অজুহাত তুলে দেশজুড়ে বহু মাজার ও স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। কবর থেকে লাশ তুলে নুরাল পাগলার লাশ পর্যন্ত পোড়ানো হয়েছে। বিচারহীন এসব ঘটনায় উগ্রবাদী উসকানিমূলক শক্তির প্রভাব স্পষ্ট। রাষ্ট্রের অত্যন্ত দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকেও একজন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এমন বর্ণবাদী উসকানিমূলক বক্তব্য উগ্রবাদী শক্তিকে আরও বেশি মব সন্ত্রাসে উৎসাহিত করতে পারে। এ ধরনের দায়িত্বহীন আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার ও মন্তব্য প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় পদে থাকা অবস্থায় কেউ যেন ভবিষ্যতে কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব নিয়ে অপমানজনক বা বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করতে না পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও দাবি জানানো হয়েছে। বিবৃতিদাতারা আসন্ন দুর্গাপূজার সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক আয়োজনের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি হিন্দুসহ সব ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর ধর্মীয় ও সামগ্রিক জীবনের নিরাপত্তায় প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার আলোকে বহুত্ববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে সব ধরনের উগ্রবাদী, বৈষম্যমূলক ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ও আচরণ বর্জন করে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সম্প্রীতির সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে হবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন:
- মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল
- আইন ও সালিস কেন্দ্রের চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না
- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
- টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান
- এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা
- সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী
- তবারক হোসেন
- ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও মানবিক বিভাগের অধ্যাপক ফিরদৌস আজীম
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের
- নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন
- ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব
- গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস
- নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন
- কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী
- লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ
- উন্নয়নকর্মী সৈকত শুভ্র আইচ
- নৃবিজ্ঞান গবেষক জবা তালুকদার
- অধিকারকর্মী রোজীনা বেগম
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম
- মানবাধিকারকর্মী আমিরুল রসুল
- সাঈদ আহমেদ
- আদিবাসী অধিকারকর্মী হানা শামস আহমেদ