ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে প্রার্থীদের সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, সামাজিক যোগাযোগ ও সাইবার মাধ্যমে অপতথ্য রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং নির্বাচনে শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করার সুপারিশ এসেছে সাংবাদিকদের কাছ থেকে।
সাংবাদিকরা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ভোটের আগে ভোটার ও অংশীজনদের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিত করা এবং ভোটে শক্তি ও সম্পদের অপপ্রয়োগ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। একই সঙ্গে প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য দ্রুত প্রকাশ করে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
সোমবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রিন্ট ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে আয়োজিত সংলাপে এসব সুপারিশ উঠে আসে।
সংলাপের শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। “নির্বাচন ভালো না হওয়ার কোনো সুযোগ জাতি হিসেবে আমাদের কাছে নেই। সুতরাং সবাই মিলে নির্বাচনটা করতে হবে। এটা একটা জাতীয় নির্বাচন এবং জাতীয়ভাবেই আমরা করতে চাই,” বলেন সিইসি।
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে এককভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। আপনারা মানুষের মতামত তৈরি করার কারিগর, আমরা সেই সুযোগটা নিতে চাই। এই নির্বাচন অবাধ-নিরপেক্ষ করতে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে চাই।”
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসেবে তফসিল ঘোষণা হতে পারে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। এর আগে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করছে ইসি। গত ২৮ সেপ্টেম্বর নাগরিক সমাজ ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হয়। পূজার ছুটির পর সাংবাদিকদের সঙ্গে এই সংলাপ বসে। মঙ্গলবার নারী নেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ হবে। চলতি মাসেই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করবে কমিশন।
সাংবাদিকদের সুপারিশ:
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ বলেন, “আপনাদের মেরুদণ্ডসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে জাতির কাছে দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও অঙ্গীকারের পরিচয় দিতে হবে।” তিনি আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে কমিশনের অবস্থান জাতির সামনে স্পষ্ট করার আহ্বান জানান।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে প্রতিটি এলাকায় সামাজিক ও পেশাজীবী নেতা ও তরুণদের নিয়ে নজরদারি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি।
অপতথ্য রোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নজরদারি চালু এবং সাইবার সক্ষমতা বাড়ানোর আহ্বান জানান হাসান হাফিজ।
এছাড়া প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে পোস্টাল ব্যালট প্রক্রিয়া সহজ করা এবং ঢাকার বাইরেও সংলাপ আয়োজনের প্রস্তাব দেন তিনি।
দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন সাইবার অপরাধ ও মিথ্যা তথ্য রোধে কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে আহ্বান জানান।
দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক আব্দুল হাই সিকদার বলেন, “দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। এই অবস্থায় নির্বাচন আয়োজন ঝুঁকিপূর্ণ।” প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যে এখনও ‘ফ্যাসিস্টের দোসররা’ আছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
দৈনিক প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ প্রার্থিতা কেনাবেচা বন্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি প্রার্থীদের হলফনামার সঙ্গে ট্যাক্স রিটার্ন জমা, যাচাই-বাছাই ও নির্বাচনি ব্যয় তদারকির প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে কমিশনের কার্যক্রম দৃশ্যমান করার পরামর্শ দেন তিনি।
ডেইলি ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক সামসুল হক জাহিদ বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় অঞ্চলভিত্তিক আলাদা দিনে ভোট নেওয়া যেতে পারে।”
দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আযম মীর শহীদুল আহসান বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন নির্বাচন কমিশনের বড় দায়িত্ব। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা জরুরি।” তিনি একাধিক দিনে ভোটগ্রহণ ও সকালে গণনা শুরু করার প্রস্তাব দেন।
অনলাইন ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল বলেন, “ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
দৈনিক নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী বলেন, “নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা তৈরি করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।” তিনি বল ও অর্থের অপব্যবহার বন্ধে নজরদারি বাড়ানোর ও কর ও ঋণখেলাপিদের প্রার্থী হতে না দেওয়ার আহ্বান জানান।
দৈনিক আজকের পত্রিকার সম্পাদক কামরুল হাসান প্রার্থীদের হলফনামা জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশের প্রস্তাব দেন।
দৈনিক খবরের কাগজের সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন না হলে সমাজে বিভাজন বাড়বে। সবাইকে ভোটে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।”
দৈনিক আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক এহসান মাহমুদ স্থানীয় পর্যবেক্ষক মনোনয়ন বিষয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও সাইবার ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে বাস্তব মহড়া প্রদর্শনের আহ্বান জানান।
বাংলাবাজার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রাশেদুল হক বলেন, “ভোটের দিন ও আগের রাতে সাংবাদিকদের কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে।”
দৈনিক খবর সংযোগের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম প্রার্থীদের অগ্রিম প্রচারণা ও ব্যানার-বিলবোর্ড অপসারণের প্রস্তাব দেন।
কমিশনের প্রতিক্রিয়া:
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, “হলফনামায় ভুল তথ্য থাকলে এবার আমরা প্রার্থীতা বাতিল করতে পারব, এমন বিধান সংযোজন করেছি।”
তিনি জানান, “প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় সব প্রার্থী একই প্ল্যাটফর্মে এসে অবস্থান তুলে ধরবেন।”
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে তিনি বলেন, “আগে তারা নির্বাচন খারাপ করতে কাজ করেছে, এবার ভালো করতে কাজ করবে।”
ভোটকেন্দ্রে রোভার স্কাউটদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত করার চিন্তাও রয়েছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা নিয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পদধারীরা যেসব সংস্থায় ছিলেন, তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, “বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
সামাজিক মাধ্যম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহারকে তিনি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন।
সংলাপটি সঞ্চালনা করেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব আলী নেওয়াজ। এতে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার বেগম তাহমিদা আহমদ, আব্দুর রহমানেল মাছউদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সংবাদকর্মীরা।