বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া রঙে বিপজ্জনক মাত্রার সীসা পাওয়া গেছে

বাংলাদেশে গৃহসজ্জার কাজে ব্যবহৃত ডেকোরেটিভ রঙে এক গবেষণায় ১,৯০,০০০ পিপিএম পর্যন্ত সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যেখানে আইন অনুযায়ী রঙে সীসার নিরাপদ সর্বাধিক মাত্রা ৯০ পিপিএম।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার এসডোর প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে লেড এক্সপোজার এলিমিনেশন প্রজেক্ট, ইন্সটিগ্লিও, বিএসটিআই এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় ‘রঙে সীসার উপস্থিতি এবং সীসামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অগ্রগতি মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পরীক্ষিত মোট ১৬১টি রঙের নমুনার মধ্যে ৯৩টি (৫৭.৮%) নমুনায় নিরাপদ মাত্রার (৯০ পিপিএম-এর কম) সীসা পাওয়া গেছে। এই নমুনার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ব্র্যান্ড যেমন বার্জার, এশিয়ান পেইন্টস, নিপ্পন ইত্যাদি।

অন্যদিকে ৬৮টি নমুনায় (৪২.২%) সীসার মাত্রা বিএসটিআই নির্ধারিত ৯০ পিপিএম-এর সীমা অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ২৬.২% নমুনায় ১,০০০ পিপিএম-এর বেশি এবং ৩.১% নমুনায় ৫০,০০০ পিপিএম-এর বেশি সীসা উপস্থিত। এ ধরনের ব্র্যান্ডগুলো মূলত ছোট, স্থানীয় বা অনিবন্ধিত কোম্পানি, যাদের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাব রয়েছে।

এসডোর চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, “জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সকল প্রকার রঙ থেকে সীসা নির্মূল করার জন্য কর্তৃপক্ষ এবং শিল্প খাতের স্টেকহোল্ডারদের কাছে অবিলম্বে পদক্ষেপ দাবি করছি। উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যবহারে সম্মিলিত দায়বদ্ধতার পক্ষে আমরা কথা বলছি।”

এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “এই গবেষণাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, কেবল আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ বাস্তবায়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কাউকে দোষারোপের জন্য নয়, বরং সম্মিলিতভাবে সংকট মোকাবিলায় কাজ করতে চাই, যেখানে শিল্পকলা, উৎপাদন এবং নিরাপত্তা অপরিহার্য।”

এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, “যদি আমরা যে রং ব্যবহার করি তা নিরাপদ না হয়, তবে এটি প্রতিটি পরিবার এবং শিল্পীর জন্য জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং মানসিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সীসামুক্ত বাংলাদেশে সকল স্টেকহোল্ডারের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

বিএসটিআই-এর পরিচালক (কেমিক্যাল উইং) খোদেজা খাতুন বলেন, “যেসব ব্র্যান্ড সীসার মানদণ্ড মানছে না, তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা রয়েছে, তবে আমরা এগুলো সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”

গবেষণার ফলাফল

  • ক্যাঙ্গারু ব্র্যান্ডে ১,৯০,০০০ পিপিএম পর্যন্ত সীসার সর্বোচ্চ উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছে।
  • ইউরো ব্র্যান্ডে ১,৭০,০০০ পিপিএম।
  • অন্যান্য উচ্চ মাত্রার সীসাযুক্ত নমুনার মধ্যে রয়েছে: নাহার (৮১,০০০ পিপিএম), নিউ টুয়া (৭৪,০০০ পিপিএম), টপ সিল (৫৪,০০০ পিপিএম), মদিনা বেটার রুবিল্যাক (১৯,০০০ পিপিএম), মেঘনা প্লাস (১৮,০০০ পিপিএম), র্যামি (১৮,০০০ পিপিএম) এবং তুর্কি (১৬,০০০ পিপিএম)।
  • এই রংগুলো হলুদ বা সোনালি-হলুদ রঙের অয়েল ডেকোরেটিভ রং।
  • হলুদ রঙে সর্বোচ্চ সীসার উপস্থিতি, লাল ও সাদা রঙেও উচ্চ মাত্রা দেখা গেছে।

অন্যান্য তথ্য

  • কিছু শিল্পকারখানার ব্যবহারিক রংও বাজারে ডেকোরেটিভ রঙ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।
  • মাত্র ২১.৬% রঙে (১৬১টির মধ্যে ৩৫টি) ‘সীসামুক্ত’ বা ‘পরিবেশ-বান্ধব’ লেবেল ছিল।
  • জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকের বেশি দোকানদার বিএসটিআই-এর সীসার সীমার বিষয়ে অবগত ছিলেন না।
  • ১০,০০০ পিপিএম-এর বেশি সীসাযুক্ত নমুনা সকলই ক্ষুদ্র বা অনানুষ্ঠানিক উৎপাদকদের কাছ থেকে এসেছে।
  • চীন ও সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা কিছু নমুনাতেও উচ্চ মাত্রার সীসা পাওয়া গেছে, যা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও কাস্টমস স্ক্রিনিংয়ের দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়।

গবেষণায় NIOSH মেথড ৭৩০৩ অনুসরণ করে Inductively Coupled Plasma–Optical Emission Spectroscopy (ICP-OES) ব্যবহার করে নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বাজার জরিপ ও পেইন্ট শিল্প সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে লেবেলিং, সচেতনতা ও বাজার অনুশীলন মূল্যায়ন করা হয়েছে। সমস্ত পরীক্ষা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত Wisconsin Occupational Health ল্যাবে পরিচালিত হয়েছে।

এসডো প্রতিবেদনে বাধ্যতামূলক সেফটি লেবেল এবং নিয়মিত পণ্য পরীক্ষার সুপারিশ করেছে। এছাড়া স্বাস্থ্য ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং বিকল্প খুঁজে বের করা, টেকসই কৃষি অনুশীলন প্রচার এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে।