পর্যটক-শূন্য প্রথম দিন: সেন্ট মার্টিন ঘাটে নীরবতা, কোনো জাহাজ ছাড়েনি

নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে ১ নভেম্বর থেকে প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে কক্সবাজার থেকে কোনো জাহাজ ছাড়েনি। সকালজুড়ে শহরের নুনিয়ারছড়াস্থ বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে নীরবতা বিরাজ করছিলো, আর পর্যটকের আনাগোনা ছিল না বললেই চলে।

সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানান, সকালে মাত্র চারজন যাত্রী ঘাটে এসেছিলেন, পরে তারাও ফিরে যান। তিনি বলেন, “কক্সবাজার থেকে এত দীর্ঘ সমুদ্র পথে দিনে গিয়ে দিনে ফেরার সিদ্ধান্তে পর্যটক পাওয়া সম্ভব নয়। এই বাস্তবতায় জাহাজ চালানো সম্ভব নয়।”

অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সেন্ট মার্টিন রুটে বর্তমানে আটটি জাহাজ রয়েছে, যা নিয়মিতভাবে সর্বমোট ৩৬০০ যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম। তবে সরকারের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, দিনে সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক যাতায়াত করতে পারবেন। জাহাজ মালিকরা এই সীমাবদ্ধতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

বাহাদুর বলেন, কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন পৌঁছাতে সময় লাগে সাত থেকে সাড়ে সাত ঘণ্টা; আসা-যাওয়ার জন্য মোট সময় লাগে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা। এক ঘণ্টা দ্বীপে অবস্থানের সুযোগে পর্যটকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। “দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে আগ্রহী পর্যটক গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ জন। কিন্তু একটি জাহাজ চালু রাখতে অন্তত ৩৫০ যাত্রী প্রয়োজন। একবার যাত্রায় খরচ পড়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা। তাই কম যাত্রী নিয়ে জাহাজ চালানো সম্ভব নয়।”

অন্যদিকে, উখিয়ার ইনানী জেটি ব্যবহার করলে সময় কমে আট থেকে নয় ঘণ্টায় পৌঁছানো যেত। তবে পরিবেশগত কারণে অনুমতি নেই। টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকেও সময় বাঁচানো সম্ভব, কিন্তু মিয়ানমারের সীমান্তে সংঘাত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে তা কার্যকর করা যায় না।

মোটের উপর, শর্তের কড়াকড়ি, উচ্চ খরচ ও নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তায় নভেম্বরে সেন্ট মার্টিন রুটে জাহাজ চালাতে রাজি নন মালিকরা। তারা অভিযোগ করেছেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয় বাস্তবতা বিবেচনা না করে নির্দেশনা দিয়েছে। এতে পর্যটন শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে এবং দ্বীপের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশায় আছে। তাই নির্দেশনা পুনর্বিবেচনার দাবি করেছেন তারা।

সেন্ট মার্টিনের রিসোর্ট ব্যবসায়ী নুরুল হাসান বলেন, “আমরা চাই পরিবেশ বাঁচুক, তবে সিদ্ধান্তটি বাস্তবসম্মত হতে হবে। ১৫ ঘণ্টা সমুদ্রযাত্রা করে কেউ এক ঘণ্টা দ্বীপে থেকে ফিরে আসবে না। এতে পর্যটন নয়, ক্ষতিই হবে।”

ঢাকা থেকে আসা দম্পতি তামান্না ও রুবেল হোসেন জানান, “আমরা ছুটি নিয়ে এসেছিলাম সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য। কিন্তু শুনেছি কোনো জাহাজ যাচ্ছে না। এত দূর থেকে এসে খালি হাতে ফিরতে হবে, ভাবতেই খারাপ লাগছে।”

কক্সবাজারে ঘুরতে আসা চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ইফাজ উদ্দিন বলেন, “সেন্ট মার্টিনে রাত কাটানোই মূল আনন্দ। দিনে গিয়ে দিনে ফেরার নিয়মে সেই আনন্দ হারিয়ে যাবে। যদি সরকার অন্তত সপ্তাহে দুদিন রাত্রিযাপনের সুযোগ দিত, তাহলে পর্যটকরাও যেত, ব্যবসার চাকা ঘুরত।”

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মান্নান জানান, “সেন্ট মার্টিনে পর্যটক পরিবহনের জন্য ছয়টি জাহাজকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ট্যুরিজম বোর্ডের ওয়েব পোর্টাল চালু হয়েছে, টিকিট বিক্রিও শুরু হয়েছে। যাত্রীর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে মালিকপক্ষ যেকোনো সময় জাহাজ চালু করতে পারবে।”

২২ অক্টোবর পরিবেশ অধিদপ্তর জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নভেম্বর থেকে সেন্ট মার্টিনে নৌযান চলাচল করা যাবে, তবে রাত্রীযাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক দ্বীপে অবস্থান করতে পারবেন। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১২ দফা নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

প্রথম দিনেই বাস্তব পরিস্থিতি প্রমাণ করেছে যে, এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। ঘাটে ছিল নিঃশব্দ নিরবতা, কোনো জাহাজ ছাড়েনি।