“চিঠি দিয়ে লাভ হবে না, নির্বাচন অভ্যন্তরীণ বিষয়” : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘে আওয়ামী লীগের পাঠানো চিঠি কার্যকর হবে না বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “এ ধরনের চিঠিতে কোনো ফল মিলবে না। নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।”

এর আগে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-কে চিঠি পাঠানো হয়। শনিবার পাঠানো ওই চিঠিতে দলটি বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ইউএনডিপি ও জাতিসংঘের কারিগরি সহায়তা বন্ধের আহ্বান জানায়। দলটির পক্ষে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চিঠিটি পাঠান।

চিঠিতে বলা হয়, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘ ও ইউএনডিপির সহযোগিতা স্থগিত রাখা উচিত। একই সঙ্গে দলটি সব রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার আহ্বান জানায়।

“বাংলাদেশে ইউএনডিপির নির্বাচনি সহায়তা, ব্যালট প্রজেক্ট এবং নির্বাচন সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের নিরপেক্ষতা নষ্ট হচ্ছে”— এমন অভিযোগও তোলা হয় চিঠিতে। আওয়ামী লীগ বলেছে, এসব কার্যক্রম ইউএনডিপির ম্যান্ডেটের পরিপন্থী এবং অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটি আরও দাবি করে, দেশে বর্তমানে এক নিবর্তনমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে; হাজার হাজার নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও নাগরিক হুমকি কিংবা আটক অবস্থায় আছেন। রাজনৈতিক সংলাপের সুযোগ ভেঙে পড়েছে, ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে— যা অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরাও সক্রিয়ভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন বলে আওয়ামী লীগের অভিযোগ।

চিঠিতে বলা হয়, “বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংলাপ, সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পুনঃস্থাপন জরুরি, যার মধ্যে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি ও সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।”

আওয়ামী লীগ আরও আহ্বান জানায়, ইউএনডিপির ভূমিকা যেন কাউকে বাদ দেওয়া বা রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণ না হয়, সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক পুনর্মূল্যায়ন করা হোক।

অন্যদিকে, দলটির সমালোচকরা মনে করেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নয় এমন নির্বাচনের বিষয়ে জাতিসংঘে চিঠি পাঠানোর নৈতিক অধিকার আওয়ামী লীগের নেই। কারণ, তাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এরপর থেকে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হয় ক্ষমতাসীন দলের অধীনে।

দশম ও দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপি ও বেশিরভাগ বিরোধী দল অংশ নেয়নি। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন— যেটিকে বিরোধীরা “বিনা ভোটের নির্বাচন” বলে আখ্যা দেয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অংশ নিলেও ভোট আগের রাতে সম্পন্ন হওয়ার অভিযোগ ওঠে; সেই নির্বাচন পরে “নীশিরাতের নির্বাচন” নামে পরিচিতি পায়।

২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি বর্জন করায় আওয়ামী লীগ শরিক ও বিরোধী জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছাড়ে, আর দলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। সেই ভোটের নাম হয় “আমি আর ডামি” নির্বাচন।

তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে টানা ১৫ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকে আওয়ামী লীগ। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।

এরপর হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে।

একই অভিযোগে বিএনপি গত জুনে মামলা করে, যেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা আসামি হিসেবে আছেন।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলনে দমন-পীড়নে অন্তত এক হাজার ৪০০ জন নিহত ও কয়েক হাজার আহত হয়। সেই সহিংসতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার চলছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে দল হিসেবেও আওয়ামী লীগের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে, ফলে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ হারায়।