তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় একমত দলগুলো, রূপরেখা নিয়ে ভিন্নমত

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমত হলেও এর কাঠামো ও কার্যপ্রণালি নিয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা বাছাই, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের ভূমিকা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কি না—এসব বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের অষ্টম দিনের আলোচনায় এ মতপার্থক্য উঠে আসে। আলোচনা হয় সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, আইনসভার মেয়াদ শেষে বা ভেঙে যাওয়ার পর নতুন সরকার শপথ নেওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৯০ দিনের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার থাকবে। এ সরকারে প্রধান উপদেষ্টাসহ সর্বোচ্চ ১৫ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের দায়িত্ব ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর। তবে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার পর ঐকমত্য কমিশন এই কাউন্সিলের প্রস্তাব থেকে সরে এসে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে।

আগে সংবিধানে যে রূপরেখা ছিল, আলোচনায় মূলত সেটিই সামনে আনা হয়। আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ে বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে বাইরে রাখার কথা বলা হয়েছিল। বিচার বিভাগ চাইছে এখান থেকে দূরে থাকতে। তাই অন্তত দুটি বিকল্প থাকা উচিত, প্রয়োজনে পরে বিচার বিভাগকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তবে কী কী বিকল্প হতে পারে, তা তিনি উল্লেখ করেননি।

বিএনপির প্রস্তাব অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তিন মাস, যা দৈবদুর্বিপাকের কারণে এক মাস বাড়ানো যেতে পারে। তাদের মতে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে হওয়া উচিত নয়।

জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে চার মাস এবং এই সরকারের অধীনেই জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন—দুটোই অনুষ্ঠিত হবে। সময়সীমা না মানা গেলে আরও দুই মাস সময় বাড়ানো যেতে পারে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগে থেকেই একটি রূপরেখা কমিশনের কাছে জমা দেয়। তারা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে এবং সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সুপারিশ করে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়োগ দিলে বিচারাঙ্গনে রাজনীতিকরণ শুরু হবে।

আলোচনায় অংশ নেওয়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানেও প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতির বাড়তি দায়িত্ব দেওয়ার বিপক্ষে মত প্রকাশ করা হয়। তবে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতি গোপন ব্যালটে নির্বাচিত হন, তাই শেষ বিকল্প হিসেবে তাকেও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।

আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানান, রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গঠনের বিষয়ে অভিন্ন মত পোষণ করেছে। কাঠামো ও এখতিয়ার নিয়েও আলোচনা হয়েছে এবং অনেক বিষয়ে দলগুলো কাছাকাছি এসেছে।

আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

এদিনের আলোচনায় সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ নিয়েও ঐকমত্য হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে, যদি তা আগে থেকেই না গঠিত হয়ে থাকে। প্রয়োজনে এতে পরিবর্তন আনা হবে এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করা হবে।