সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তথ্য নিয়ে ঐক্য পরিষদ ও পুলিশের মধ্যে বিরোধ

গেল ছয় মাসে ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়’ হতাহতের যে তথ্য বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চা দিয়েছে, তার সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ বলছে, একটি ঘটনাও ‘সাম্প্রদায়িক কারণে’ ঘটেনি।

সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে ‘রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে অস্বীকার করা’ এবং অপরাধীদের ‘দায়মুক্তি’ দেওয়ার অভিযোগ করা হলেও পুলিশ সদর দপ্তরের দাবি, প্রত্যেকটি ঘটনা ‘আন্তরিকতা ও গুরুত্বের’ সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে গত ছয় মাসে ‘সাম্প্রদায়িক কারণে’ ২৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য দেয় সংগঠন দুটি। তারা আরও দাবি করে, গত ১১ মাসে ২ হাজার ৪৪২টি সাম্প্রদায়িক হামলা ও সহিংসতা ঘটেছে।

তাদের এসব দাবির বিষয়ে মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, “২৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্যে ২২টিতে হত্যা মামলা এবং ৫টিতে অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।”

হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে পুলিশ জানায়, জায়গাজমি সংক্রান্ত বিরোধে দুজন, আর্থিক লেনদেনে দুজন, ডাকাতি বা দস্যুতায় সাতজন, সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য সন্দেহে একজন, তরমুজ ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে মারামারিতে একজন এবং গলায় ‘ফাঁস নিয়ে’ তিনজন আত্মহত্যা করেছেন।

বাকি ১১ জনের মধ্যে কেউ ভবঘুরে, কেউ জুম চাষে গিয়ে, কেউ তামাক ক্ষেত থেকে পাতা কুড়াতে গিয়ে মারা গেছেন বলে জানায় পুলিশ। এসব হত্যাকাণ্ডে ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ১৫ জন আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং ১৮ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

পুলিশ জানায়, “কোনো হত্যাকাণ্ডই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বা সাম্প্রদায়িকতার কারণে সংঘটিত হয়নি।”

সংগঠন দুটি যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ২০টি ঘটনার কথা উল্লেখ করলেও পুলিশ বলেছে, ২০টি ঘটনার মধ্যে ১৬টিতে মামলা হয়েছে এবং ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনটি ঘটনায় কোনো অভিযোগ দায়ের হয়নি।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “রাজশাহীর তানোরে আদিবাসী নারী ধর্ষণের সত্যতা পাওয়া যায়নি। অভিযুক্তের সঙ্গে ভুক্তভোগীর পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল। মাগুরার শ্রীপুরে কিশোর কুমারের স্ত্রীর গণধর্ষণের অভিযোগও প্রাথমিক তদন্তে সত্য প্রমাণিত হয়নি।”

সংগঠন দুটি দাবি করেছে, গেল বছরের ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটেছে। তারা যে ২ হাজার ১০টির মধ্যে ১ হাজার ৭৬৯টি ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’ বলে দাবি করেছে, তাতেও দ্বিমত জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশের ভাষ্য, “১ হাজার ৭৬৯টি ঘটনা যাচাই করে ৫৬টি জেলায় ১ হাজার ৪৫৭টি ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬২টি ঘটনায় মামলা ও ৯৫১টি ঘটনায় জিডি হয়েছে। ৬২ ঘটনায় ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্তে দেখা যায়, ১ হাজার ৭৬৯টির মধ্যে ১ হাজার ৪৫২টি ঘটনা ৫ আগস্টের, যার ১ হাজার ২৩৪টি রাজনৈতিক বিরোধসংক্রান্ত। ১৬১টির সত্যতা পাওয়া যায়নি।”

৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত পূজা মণ্ডপ বা উপাসনালয়ে ১২৭টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৬৬টি ঘটনায় মামলা ও ৬১টি ঘটনায় জিডি হয়। এসব মামলায় ৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে মন্দির বা পারিবারিক মন্দিরে চুরি, প্রতিমা ও মন্দির ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, জমি দখল ও উচ্ছেদের মোট ৬০টি ঘটনার অভিযোগ করা হয়। পুলিশ জানায়, তারা ২০টি চুরির সংবাদ পেয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি মামলা ও পাঁচটি জিডি হয়েছে।

পুলিশের এই ব্যাখ্যা নিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, “তারা বলতে চাচ্ছে ঘটনাগুলো অসত্য নয়, কিন্তু সেগুলো সাম্প্রদায়িক নয়, ন্যাচারাল। তবে আমরা দৃঢ়ভাবে বলছি, এসব সম্পূর্ণরূপে সাম্প্রদায়িক ঘটনা।”

তিনি মনে করেন, এসব ঘটনায় সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। অন্যথায় সংখ্যালঘুদের জনজীবন বিপন্ন হবে।