একই আয়ে বাড়ল করের বোঝা: নতুন বিধানে কর দিতে হবে আরও বেশি

বছর ঘুরে ব্যক্তির আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময়সীমা আবার সমাগত প্রায়। এখন সেই প্রস্তুতি নেওয়ার পালা। মাস খানেক পরে জোরেশোরে শুরু হবে সেই তোড়জোড়।

এরই মধ্যে কেউ কেউ কাগজ-কলম নিয়ে খসড়া হিসাব করতে বসে গেছেন—নতুন আয়কর হার অনুযায়ী নিজের আয় থেকে কর দিতে হবে কত? বিশেষ করে যাদের মাসিক আয় কিছু বেশি।

কোনো ব্যক্তির মাসিক আয় আগের মতো এক লাখ টাকা থাকলে চলতি অর্থবছরে (আয়বর্ষ) নতুন হিসাবে তাকে কত টাকা আয়কর দিতে হবে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। হিসাব করে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে (আয়বর্ষ) যার মাসিক আয় ১ লাখ টাকা ছিল এবং দুই ঈদে যদি তার বোনাস হয় আরও ১ লাখ টাকা; তাহলে তার বার্ষিক আয়ের ওপর আয়কর আসত ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা। চলতি অর্থবছরে (আয়বর্ষ) এ পরিমাণ আয়ের ওপর নতুন বিধান অনুযায়ী আয়কর আসবে ৫৮ হাজার ৭৫০ টাকা।

অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের জন্য যে অর্থ আইন করা হয়েছে, তাতে একই বেতন বা আয় থাকা সত্ত্বেও তার আয়কর বাড়বে ১১ হাজার ২৫০ টাকা বা ২৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। কর রেয়াতের হিসাব যুক্ত করলে দেখা যায়, নতুন বিধান অনুযায়ী আয়কর বেড়েছে ৫২ দশমিক ৩২ শতাংশ। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ করছাড় নেওয়ার পর গত অর্থবছরের (আয়বর্ষ) আয়ের ওপর আয়কর দিতে হয়েছিল ২১ হাজার ৫০০ টাকা। আর চলতি অর্থবছরে আয়ের ওপর আয়কর আসবে ৩২ হাজার ৭৫০ টাকা।

২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে একজন ব্যক্তি যে আয় করবেন, তার ওপর তাকে নতুন হারে কর দেওয়ার বিধান করায় কর বেড়েছে। করমুক্ত আয়সীমার নতুন বিধান অনুযায়ী, এই সময়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আয়ের জন্য কর দিতে হবে না। এর বেশি আয়ের জন্য কর দিতে হবে বাজেটে ঘোষিত নতুন করধাপ অনুযায়ী। সেক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কর হারও তুলে দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

তবে একজন করদাতা তার আয় থেকে যথার্থ বিনিয়োগ পরিকল্পনা করলে বড় অঙ্কের কর ছাড় পেতে পারেন। এক্ষেত্রেও দেখা যায়, নতুন বিধান অনুযায়ী কেউ সর্বোচ্চ ছাড় নিলেও তার করের পরিমাণ বাড়ার হারও আগের বারের চেয়ে বেশি হবে।

হিসাব কী বলছে

একজন সাধারণ ব্যক্তি করদাতা যদি এক লাখ টাকা মাসিক বেতন এবং উৎসব বোনাস হিসেবে আরও ১ লাখসহ মোট ১৩ লাখ টাকা আয় করেন, তাহলে প্রথমেই তার আয়ের এক তৃতীয়াংশ বা ৫ লাখ টাকা, যেটি কম হবে, তা করমুক্ত। এক্ষেত্রে করমুক্ত আয় হচ্ছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৪ টাকা; অর্থাৎ করযোগ্য আয় হচ্ছে ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬ টাকা।

এর মধ্যে প্রথম সাড়ে ৩ লাখ টাকার ওপর আয়কর শূন্য। পরের এক লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ হারে কর হবে ৫ হাজার টাকা। পরবর্তী ৪ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর ৪০ হাজার টাকা। এবং বাকি ১৬ হাজার ৬৬৬ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে করের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ আয়কর দিতে হবে ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা।

নতুন বিধানেও একইভাবে আয়ের এক তৃতীয়াংশ বা ৫ লাখ টাকা, যেটি কম হবে, তা করমুক্ত। সেক্ষেত্রে করমুক্ত আয় থাকছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৪ টাকা; করযোগ্য আয় হচ্ছে ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬ টাকা।

এবার প্রথম ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ওপর কর শূন্য। পরবর্তী ৩ লাখ টাকার ওপর কর ১০ শতাংশ হারে ৩০ হাজার টাকা। এবং পরের স্তরে বাকি ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৬৬ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর ২৮ হাজার ৭৫০ টাকা। অর্থাৎ নতুন বিধানে আয়কর আসবে ৫৮ হাজার ৭৫০ টাকা।

কর রেয়াত কত?

এ আয় থেকে কর রেয়াতের বিধান আগের মতোই রয়েছে। নিয়ম হলো—করযোগ্য আয়ের ৩ শতাংশ বা অনুমোদনযোগ্য বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ বা ১০ লাখ টাকা—যেটি কম হবে সেটি রেয়াত পাবেন করদাতা।

এখন করযোগ্য আয়ের তথা ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬ টাকার ৩ শতাংশ হারে কর রেয়াত ধরা হলে ছাড় হবে ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ বেতন সমান থাকার পরও সর্বোচ্চ রেয়াত শেষে আগের অর্থবছরে আয়কর আসত ২১ হাজার ৫০০ টাকা। সেখানে নতুন বিধান অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে আয়কর আসবে ৩২ হাজার ৭৫০ টাকা। অর্থাৎ নতুন বিধানের ফলে একজন সাধারণ করদাতার ওপর করের বোঝা বাড়ল ১১ হাজার ২৫০ টাকা বা ৫২ দশমিক ৩২ শতাংশ।

রেয়াত পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা, শর্ত ও যোগ্যতা সাপেক্ষে বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে আয়কর আইনে।

আয়কর বিষয়ে অভিজ্ঞ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, একজন সাধারণ করদাতাকে সর্বোচ্চ কর রেয়াত পেতে তার করযোগ্য আয়ের ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হয়। ফর্মুলা হলো ২০ শতাংশ, সোজা কথা। এ হিসাবে এক লাখ টাকা মাসিক আয় হলে সর্বোচ্চ রেয়াত পেতে তার মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হতে হবে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।

বিনিয়োগ পরিকল্পনায় করদাতা কোথায় বিনিয়োগ করবেন—এ বিষয়ে তিনি বলেন, “সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সরকারি সিকিউরিটিজ। এটা সবচেয়ে নিরাপদ। দ্বিতীয়ত হচ্ছে ‘ভালো’ বীমা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা। তৃতীয় আসা উচিত ডিপিএস—তাও ‘ভালো’ ব্যাংকে।”

বিনিয়োগের বিভিন্ন খাতের মধ্যে রয়েছে—৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সরকারি সিকিউরিটিজ; সার্বজনীন পেনশন স্কিমের চাঁদা; স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোনো সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ; কোনো তফসিলি ব্যাংকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক সঞ্চয় ইত্যাদি।

রিটার্ন দেওয়া যাবে কবে

চলতি অর্থবছরের আয়ের ওপর আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দিতে হবে আগামী অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুলাই থেকে পরবর্তী সময়ে। সাধারণত ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। এ সময়কে বলা হয় করবর্ষ। উৎসে কর কাটা হলে সাকুল্যে যত আয়কর হবে, তার বাকি অর্থ তখন পরিশোধ করতে হবে।

গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আয়ের ওপর চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আয়কর রিটার্ন দেওয়া যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের অগাস্ট থেকে এটি বিশেষ কয়েক শ্রেণির করদাতা ছাড়া সবার জন্য অনলাইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এদিকে ২০২৬-২৭ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে আয়কর রিটার্ন জমার সময় করছাড় পেতে হলে বিনিয়োগ ও আয়ের পরিকল্পনা শুরু করতে হবে এখনই।