সরকার পতনের দিন ভাঙচুর ও লুটপাটে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর ঘুরে দেখেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
সংস্কার কাজ শেষে নতুনভাবে জাদুঘরটির উদ্বোধনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি।
সোমবার মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস-২০২৫’ উপলক্ষে রোববার একটি বিশেষ সভার আয়োজন করা হয় জাতীয় জাদুঘরে। সেখানে কথা বলেছিলেন ফারুকী।
সেখানে জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মেরিনা তাবাসসুমও উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে স্বাধীনতা জাদুঘরের সংস্কার কাজের অগ্রগতি দেখতে ফারুকী জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
সংস্কার কাজের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে মেরিনা তাবাসসুম বলেন, “মেইনলি আমরা দেখলাম, কী অবস্থায় আছে। ওখানে তো ভাঙচুর হয়েছে। ওটা এখন পরিষ্কার করতে বলা হয়েছে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে। পরিষ্কার করে তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদেরকে; কিভাবে আমরা এটাকে নতুন করে শুরু করব।
“ওটা ঠিকঠাক করাই এখন প্রধান কাজ। হয়ে গেলে পরে ওটার ফোয়ারাটা নষ্ট, ওটা ঠিক করতে হবে, লিফট নষ্ট হয়ে গেছে, গ্লাসের রেলিং নষ্ট হয়ে গেছে ওটা ঠিক করতে হবে।”
কবে নাগাদ এসব কাজ শুরু হতে পারে প্রশ্নে তিনি বলেন, “ডিজি আছেন ন্যাশনাল মিউজিয়ামের। উনাকে বলা হয়েছে। উনাদের অধীনে যারা আছেন, তাদের নির্দেশনা দেবেন। সুবিধামতো তারা করবেন।”
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় আশা করে, স্বাধীনতা জাদুঘরের সংস্কার ও নতুনভাবে উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হবে।
দেশের স্বাধীকার-স্বাধীনতা আন্দোলন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নির্দেশনের এই স্বাধীনতা জাদুঘরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় গত বছরের ৫ অগাস্ট।
জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের সহকারী কিপার মো. গোলাম কাউছার, যিনি স্বাধীনতা জাদুঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বলেছিলেন “৫ তারিখ এ ঘটনার বিষয়ে আমি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ আছে, মামলা আছে। শুধু অফিস চালু রাখার জন্য এখন খোলা-বন্ধ রাখা হয়। না হলে এতদিনে সাপ-বিচ্ছু বাসা বাঁধত।”
জাদুঘরের ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ছবির ফ্রেমের ভাঙা কাচের টুকরো। কোথাও আবার আগুনে পুড়ে খসে পড়া পলেস্তরা; সেই সঙ্গে তীব্র পোড়া গন্ধ। সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। পুরো ভবন জুড়ে ভৌতিক অন্ধকার।
ভবনের ভেতরে ভাঙচুর করা নিদর্শন পড়ে আছে; কোথাও আবার পুড়িয়ে দেওয়া আলোকচিত্রের অবশিষ্টাংশ পড়ে রয়েছে মেঝেতে। জাদুঘরের অবস্থান ভূগর্ভে, ফলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরের চিত্র।
ছিল, এখন নেই
মুঘল শাসনামল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের বিজয় দিবস পর্যন্ত নানা ঘটনার বর্ণনাখচিত আলোকচিত্র আর নানা নিদর্শন-স্মারক ছিল স্বাধীনতা জাদুঘরে।
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই উদ্যানেই দিয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর এই উদ্যানেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।
২০১৫ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের ৪৪তম স্বাধীনতা দিবসে এ জাদুঘর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের এখতিয়ারে একটি শাখা জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত হয় স্বাধীনতা জাদুঘর।
এ জাদুঘর মূলত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে একটি বৃহৎ পরিকল্পিত নকশার অংশ। এই নকশায় রয়েছে একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার, তিনটি জলাধার, ‘শিখা চিরন্তন’, স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্রবিশিষ্ট একটি ম্যুরাল এবং ১৫৫ আসন বিশিষ্ট একটি অডিটোরিয়াম।
তবে পুরো নকশার প্রধান বিষয় হল একটি ৫০ মিটার বিশিষ্ট আলোক স্তম্ভ, যা ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ নামে পরিচিত। স্তম্ভটি কাচের প্যানেল দিয়ে নির্মিত। এই স্তম্ভের নিচেই স্বাধীনতা জাদুঘর।
স্বাধীনতা জাদুঘর বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ভূগর্ভস্থ জাদুঘর। জাদুঘর প্লাজা ৫ হাজার ৬৬৯ বর্গমিটার টাইলস দিয়ে আবৃত। এই প্লাজা চত্বরের পূর্ব পাশের দেয়ালে টেরাকোটা ম্যুরালের অংশবিশেষও নষ্ট করা হয়েছে।
জলাধারের উপরে একটি ফোয়ারা রয়েছে, যাতে উপর থেকে পানি পড়ত। এই ফোয়ারার চারপাশের মার্বেল পাথর তুলে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশি স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম ১৯৯৭ সালে একটি জাতীয় স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতা জয়ের মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজের দায়িত্ব পান। ৬৭ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত পুরো প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা।
এই জাদুঘরে ১৪৪টি কাচের প্যানেলে তিনশর বেশি ঐতিহাসিক আলোকচিত্র ছিল। ছিল টেরাকোটা, যুদ্ধের ঘটনা সংবলিত সংবাদপত্রের কাটিং। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিলিপি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে প্রচারের জন্য তৈরি করা বিভিন্ন পোস্টারও জাদুঘরে ছিল।
বৃত্তকার একটি ঘরের মাঝখানে ফোকর দিয়ে অবিরাম পানি পড়ত, যা লাখো শহীদের মা এবং নির্যাতনের শিকার নারীদের অশ্রুকে নির্দেশ করে। ‘অশ্রুপাত’ নামে এ ফোয়ারা এখন বন্ধ।
এর বাইরে বাংলাদেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং স্থাপনার চিত্র ছিল এখানে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে যে টেবিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন, তার একটি রেপ্লিকা ছিল জাদুঘরে। ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত কামানের অংশসহ বেশ কিছু নিদর্শন। তবে এখন সেসব ধ্বংসস্তূপ।
ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যসহ আর কিছু নিদর্শন, যার কিছুই অক্ষত নেই এখন।