বিসিবির পুরোনো ‘চক্রের’ মাঝখানে নতুন সভাপতি আমিনুল, সামনে কেমন পথ?

বিসিবি সভাপতি হিসেবে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য ইতোমধ্যে শেষ। শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। সদ্য দায়িত্ব নেওয়া সভাপতির জন্য কিছু সহজ প্রশ্নের আশা থাকলেও, শুরুতেই তার দিকে ছুটে আসে একের পর এক কঠিন প্রশ্ন—যেগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ঠিক তার পাশেই বসা ব্যক্তিরা!

মাত্র ৯ মাস আগে, এই একই কক্ষে, এই একই মঞ্চে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন ফারুক আহমেদ। তখন পাশে ছিলেন যাঁরা, আজ তারাই যেন তাকে একা করে দিয়েছেন। শুরুতে যারা সঙ্গী ছিলেন, এখন তার বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন। তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সভাপতির পদ থেকে। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় এবার সেই চেয়ার পেয়েছেন আমিনুল ইসলাম। তার পাশেও দেখা গেছে সেই পরিচিত মুখগুলোকেই। প্রশ্ন হলো—এই বন্ধন এবার আমিনুলকে কোথায় নিয়ে যাবে?

এই পরিচিত মুখগুলোর অনেকেই বিসিবির পরিচালক। মাহবুব আনাম দুই যুগের বেশি সময় ধরে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বারবার সরকারের পরিবর্তনে বোর্ডের চেহারা বদলালেও তিনি থেকে গেছেন। আকরাম খান, কাজী ইনাম আহমেদ, ফাহিম সিনহা, ইফতেখার রহমান—তাদেরও অনেকে একাধিক মেয়াদ ধরে পরিচালকের দায়িত্বে আছেন এবং ছিলেন নাজমুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বোর্ডে।

দীর্ঘ সময় ধরে বিসিবিতে সক্রিয় এই পরিচালকদের ঘিরে নানা সময়েই উঠেছে বিতর্ক ও অভিযোগ। তাদের সঙ্গে নিয়েই নতুন যাত্রায় বেরোতে চাইলে, সেই যাত্রা কতটা পরিচ্ছন্ন হবে—সন্দেহ থেকেই যায়। ফারুক আহমেদ এখন সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন।

ফারুকের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন ৯ পরিচালকের মধ্যে ৮ জন। কেবল আকরাম খান তাতে সই করেননি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চিঠিতে যে সব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার অনেকগুলোই আগে উঠেছে স্বাক্ষরদাতাদের বিরুদ্ধেই! সংবাদমাধ্যমে সেসব আলোচনা হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে। তবুও তারা ছিলেন বহাল।

ফারুক আহমেদের কিছু সিদ্ধান্ত কিংবা আচরণ নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু যেভাবে তাকে সরানো হলো, সেখানে বোর্ডের ভেতরের ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের’ ইঙ্গিত স্পষ্ট। বিশেষ করে অনাস্থার চিঠিতে যেভাবে অভিযোগগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে তাদের অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

চিঠিতে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেগুলোর অনেকটাই ছিল আগের সভাপতি নাজমুল হাসানের ক্ষেত্রেও। কিন্তু তখন কেউ প্রতিবাদ করেননি, এমনকি কোনো বিরোধিতাও দেখা যায়নি। তাই, ক্রিকেটের স্বার্থে নয়, বরং নিজেদের হিসাব-নিকাশ মেলাতেই এই চক্রান্ত হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।

এতসব অভিজ্ঞতা দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে—এই একই পরিচালকদের সঙ্গে নিয়ে আমিনুল কতটা কাজ করতে পারবেন? সংবাদ সম্মেলনে উঠেছে এমন প্রশ্নও: – সদ্য বিদায়ী সভাপতির হয়তো ম্যান-ম্যানেজমেন্টে ঘাটতি ছিল। আপনাকেও কিছু ‘কঠিন’ চরিত্রের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এদের ম্যানেজ করার ক্ষমতা কতটা জরুরি বলে মনে করেন? – আপনি অতীতে বিসিবির নানা অসঙ্গতি নিয়ে সরব ছিলেন। এখন যাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তারাই আপনার পাশে। অনুভূতিটা কেমন? – মাহবুব আনামসহ যারা ১০-২৫ বছর ধরে বিসিবিতে রয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই, তাদের সঙ্গে আপনি কিভাবে কাজ করবেন? – ফারুক আহমেদ ছিলেন এনএসসি মনোনীত। সেই মনোনয়ন সরিয়ে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আপনিও তাদের মনোনীত। তাদের কথামতো কাজ করতে হবে কি না, এটা কি আপনার জন্য বোঝা?

এই কঠিন প্রশ্নগুলোর জবাবে আমিনুল হঠাৎ জোরালো বক্তব্য না দিয়ে, বরং সবাইকে নিয়েই কাজ করার বার্তা দেন। তিনি বলেন, “আমরা তো একটা দল। আমার আজ থেকে শুরু। এখনো অভিজ্ঞতা নেই। চেষ্টা করব সবার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে।”

বোর্ডের বাইরে থেকে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, ভেতর থেকে সমস্যাগুলোর সমাধানে তেমনভাবে কাজ করতে চান বলে জানান তিনি। তার ভাষায়, “আমি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছি। সবকিছু ক্রিকেট থেকেই পেয়েছি। তাই সত্য বলার চেষ্টা করি। বোঝাপড়ার রাজনীতি করিনি, করবও না। সবার সঙ্গে মিলে সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব।”

তবে বিতর্কিত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে হবে—এই বাস্তবতায় আমিনুল কতটা এগোতে পারবেন, সেটি সময়ই বলবে। তার ভাষায়, “দল হিসেবে কাজ করলেই সাফল্য আসে। যেমন একজন বোলার একা কিছু করতে পারে না, ফিল্ডার, উইকেটকিপার দরকার হয়। আমরা প্রত্যেকে আলাদা সময় আলাদা ভূমিকা পালন করব।”

আমিনুলের এমন বক্তব্য হয়তো স্বাভাবিক। কারণ যাদের ভোটে সভাপতি হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেই এখনই অবস্থান নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যেসব লক্ষ্য নিয়ে তিনি এসেছেন, সেসব পূরণে বাধা হতে পারেন তার এই সঙ্গীরাই।

তবে আমিনুলের জন্য কিছুটা স্বস্তির বিষয় হলো—তিনি জানিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্বে থাকার বা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা আপাতত তার নেই। বিপরীতে, ফারুক আহমেদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী মাঠও প্রস্তুত করছিলেন। বোর্ডের একটি পক্ষও নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকায়, বিরোধ-বিপরীতমত এবং দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, যার ফলেই পদচ্যুত হন ফারুক।

আমিনুল সরাসরি সেই সংকটে না পড়লেও, যে পরিচালকদের সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে, তাদের নিয়ে পথচলা সহজ হবে—এমনটা নিশ্চিত নয়।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমিনুলের থাকলেও, বিসিবির সভাপতির পদে তার চ্যালেঞ্জ হতে পারে অনেক বড় ও জটিল।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও একটি বড় বিষয়। যারা ফারুক আহমেদকে স্বাগত জানিয়ে বসিয়েছিল, তারাই এবার তাকে সরিয়ে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আমিনুল যদিও এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চান, তবু মন্ত্রণালয়ের চাহিদা ও প্রভাবকে উপেক্ষা করার সুযোগ তার থাকবে না।

তিনি বলেছেন—সবাই মিলে দল হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু যদি সেই দলের ভেতরেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব বা প্রতিপক্ষ তৈরি হওয়ার খেলা, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, সেটির প্রমাণ তো সদ্য বিদায়ী ফারুক আহমেদই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *