রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বাসভবনে হামলার ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সেনাবাহিনী।
শনিবার গভীর রাতে রংপুর শহরের পায়রা চত্বরে বিএনপির তিনজন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন নেতার সঙ্গে কথা বলেন সেনাবাহিনীর ৭২ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুম।
এ সময় তাদেরকে হামলার ভিডিও চিত্র দেখিয়ে হামলাকারীদের শনাক্ত করার জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সহায়তা চাওয়া হয়। বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে সহায়তার আশ্বাস দেন।
এক পর্যায়ে রাত ১টার দিকে সেখানে হাজির হন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। এ সময় তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুমের সঙ্গে কথা বলেন।
তাদের দুজনের কথা বলার সময় সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
রংপুরে শহরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ‘স্কাই ভিউ’ বাসভবনে বৃহস্পতিবার রাতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। বাড়িতে ঢিল ছুড়ে জানালার কাচ ভাঙচুর ও একটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ ঘটনার পর পরই পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। তাদের মধ্যে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
জাতীয় ছাত্র সমাজের নেতা আরিফ আলী শুক্রবার গভীর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগরের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতিসহ ২২ জনের নামে রংপুর মহানগরের কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগ দেন।
একদিন পর শনিবার মধ্যরাতের দিকে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাসহ জাতীয় পার্টি ও সহযোগী অঙ্গ সংগঠনের ১৮ জন নেতাকর্মীর নামে একই থানায় অভিযোগ দেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির রংপুর জেলা সংগঠক আলমগীর রহমান নয়ন।
থানা থেকে ফেরার সময়ই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগরের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ও জেলা আহ্বায়ক ইমরান আহমেদের সঙ্গে পায়রা চত্বরে কথা বলেন সেনাবাহিনীর ৭২ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি সাংবাদিকদের বলেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ তাদেরকে ফোন দিয়ে কোথায় আছেন জানতে চাওয়া হয়। তারা পায়রা চত্বরে আছেন জানালে সেনাবাহিনী সদস্যরা সেখানে চলে আসেন। হামলার ঘটনায় জড়িতদের পরিচয় শনাক্তে তাদেরকে ভিডিও দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয় কারা জড়িত আছে। হামলাকারীদের শনাক্তে তাদের সহযোগিতা চায় সেনাবাহিনী।
“আমরা নিশ্চিত করেছি, আমাদের লোকজনের হাতে লাঠিসোঁটা ছিল না। কেউ থাকলে আমরা তথ্য দেব।”
একই সময়ে সেখানে ডেকে পাঠানো হয় মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু, সদস্যসচিব মাহফুজ উন নবী ডন ও জেলা সদস্যসচিব আনিছুর রহমান লাকুকে। তাদের কাছেও জানতে চাওয়া হয়, এ হামলার সঙ্গে তাদের দলের কোনো নেতাকর্মীরা জড়িত আছে কি-না।
পরে এ ব্যাপারে বিএনপির মহানগর কমিটির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু বলেন, “সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আমাদেরকে পায়রা চত্বরে ডাকা হয়েছে। তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, সেদিনের হামলার ঘটনায় কেউ জড়িত কি-না এবং বেশ কয়েকটি ভিডিও দেখিয়েছেন।
“এখান থেকে আমরা একজনকে শনাক্ত করেছি। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে দলের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা কথা বলছিলেন, সেই সময়টায় অর্থাৎ রাত ১টার দিকে সারজিস আলম ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন।
সেখানে তিনি লেখেন, “রংপুরে ফ্যাসিস্টদের দোসরদের গ্রেপ্তার না করে অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধাদের বিব্রত করলে আগামীকাল রংপুরের রাজপথে আবার দেখা হবে। আর আমরা সেখানে সামনের সারিতে থাকব।”
এর আধা ঘণ্টা পর বৃষ্টির মধ্যেই পায়রা চত্বরে এসে উপস্থিত হন সারজিস আলম।
সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “জাতীয় পার্টি বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হতে সমর্থন দিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগের ‘বি’ টিম জাতীয় পার্টি। তারা শান্তিপূর্ণ রংপুরে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির মাধ্যমে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
“তাদের মিটিং-মিছিলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নিচ্ছে। জিএম কাদের রংপুরে এসে গোপন বৈঠক করে জাতীয় পার্টির আড়ালে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ষড়যন্ত্র করছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এর প্রতিবাদ করে মিছিল করলে সেখানে তাদের ওপর জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের মত জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব। জাতীয় পার্টির নেতা অবৈধ ভোটে নির্বাচিত মেয়র এখন পুনর্বহাল চেয়ে আন্দোলন করছে, এটা ভালো লক্ষণ নয়। তারা কীভাবে মিটিং-মিছিল করে, আল্টিমেটাম দেয়, তাদের সঙ্গে কারা আছে আগে এসব খুঁজে বের করতে হবে।”
রংপুরের শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান সারজিস।
সেনাবাহিনীর ৭২ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুম সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের স্বার্থে সবকিছু করতে প্রস্তুত, সেটাই আমরা রংপুরে করে যাচ্ছি। দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যেটা যাবে, সেটা দলমত নির্বিশেষে যে খারাপ কাজ করবে তার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান খুবই কঠোর। কোনোভাবেই মানুষের ক্ষতি হয়, ভ্যান্ডালিজম করা, কোনো কিছু ভেঙে ফেলা– এই জিনিসগুলো করার অবকাশ আমাদের অবস্থানকালীন নেই। এটাই আমাদের বার্তা।
“উনারা দুজন আমাদের সহায়তা করতে চেয়েছেন। উনারা ভিডিও ফুটেজ এবং ছবি দেখে শনাক্ত করতে পেরেছেন কে কে আছে তাদের দলে, যাদের হাতে লাঠি এবং অন্যান্য জিনিস ছিল, সেগুলো থাকার কথা ছিল না। এজন্য তারা বিব্রতবোধ করেছেন এবং কথা দিয়েছেন আগামীকাল (রোববার) তাদের হাজির করবেন। ভবিষ্যতে তারা এমনটা করবেন না, এটা আমরা আশা করছি।”
‘মবের সুযোগ নেই’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুম ও সারজিস আলমের মধ্যে কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে। সেখানে দুজনকেই কথা বলতে দেখা যায়।
বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। তাদের সামনে আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই মুহূর্তে অনেককে ভিডিও করতেও দেখা গেছে। খবর পেয়ে তখন অনেক সংবাদকর্মীও সেখানে জড়ো হন।
এক পর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাইয়ুম এনসিপি নেতা সারজিস আলমকে বলছিলেন, “শরীরে যতক্ষণ রক্ত আছে, উই আর নট গোয়িং টু প্রমোট এনিওয়ান যে দেশের বিরুদ্ধে করে। আপাতত স্ট্যান্ডিং হল, যে জনগণের অসুবিধা করে, ভ্যান্ডালিজম করে, মবের নামে যে আগুন লাগায়, ঘরদোর ভাঙচুর করে, এই পার্টিটাকে বার্তা দেওয়া যে, না, এইটা করার সুযোগ নেই এখন।”
পরে রাত ২টার দিকে সারজিস আলম এনসিপির অন্য নেতাদের সঙ্গে সেখানে দেখা করেন।