কোরবানির গরুর লবণযুক্ত চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম গতবারের চেয়ে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬০-৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সেই দরে চামড়া বিক্রি হচ্ছে না। গতকাল শনিবার গত বছরের কাছাকাছি দরে গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে। আর ছাগলের চামড়া কেনায় ব্যবসায়ীদের কোনো আগ্রহ নেই।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সায়েন্স ল্যাব ও পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লবণ ছাড়া বড় ও মাঝারি গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যেসব গরুর চামড়া আকারে ছোট ও মান কিছুটা খারাপ, সেগুলো ৬০০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঢাকার বাইরে দাম আরও কম।
চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এবার ঈদে ৮০-৮৫ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ট্যানারিগুলো। ঈদের দিন চামড়া আসার হার সন্তোষজনক। তাঁদের দাবি, গতবারের চেয়ে প্রতি পিস কিছুটা বেশি দরে কিনছেন। তবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, চামড়া বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য মেলেনি। কেউ কেউ বলেছেন, গতবারের চেয়েও দাম কম।
গত ২৬ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম ঢাকায় ৬০-৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫-৬০ টাকা নির্ধারণ করে। গত বছর এটি ছিল যথাক্রমে ৫৫-৬০ ও ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকায় কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১-৪০, মাঝারি ২১-৩০ এবং ছোট ১৬-২০ বর্গফুট হয়। নির্ধারিত দরে ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬২৫ টাকা।
পুরান ঢাকার পোস্তা, সায়েন্স ল্যাব ও হাজারীবাগ এলাকায় দেখা গেছে, বড় ও মাঝারি গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৭০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের মতোই।
পুরান ঢাকার পোস্তার আড়তদারদের সংগঠনের একজন নেতা জানিয়েছেন, সরকার নির্ধারিত দরে ট্যানারির মালিকেরা আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া কিনবেন। তবে আড়তদারেরা চামড়া কেনার সময় ২০-৩০ শতাংশ বাদ দেন এবং ২০ ফুটের কম চামড়া নিতে চান না।
এদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ১০৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি।
ট্যানারির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে, সেই হিসাবে চামড়ার দামও কিছুটা বাড়া উচিত। তবে দুপুরের পর থেকে দাম পড়ে গেছে।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে কোরবানির চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৮৫-৯০ টাকা ছিল। এরপর দাম কমতে থাকে। ২০১৯ সালে বড় ধস নামে এবং প্রায় ২৪২ কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হয়। পরবর্তীতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসলেও নির্ধারিত দরের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে চামড়া।
রাজধানীতে দুপুরের পর পোস্তায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা, মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রতিনিধিরা চামড়া নিয়ে আসেন। আড়তদারেরা দরদাম করে কিনে তা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেন।
পোস্তার এক ব্যবসায়ী জানান, বাজার ভালো না। এবার ৬০০-৯০০ টাকায় চামড়া কিনেছেন। একজন ট্যানারি মালিক জানিয়েছেন, চামড়া প্রক্রিয়াজাতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ হয় ৩৫০-৪০০ টাকা। তাই বাজার মন্দায় কিছুটা কম দামে কিনছেন।
ছাগলের চামড়ার কোনো দাম নেই বলেও জানা গেছে। কলাবাগান থেকে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী ১৩ পিস চামড়া ১২০০ টাকা চেয়ে শেষ পর্যন্ত ৭৫০ টাকায় বিক্রি করেন। তিনি জানান, এ দামে লোকসান হচ্ছে।
আরেক ট্যানারি পরিচালক জানিয়েছেন, তাঁরা এবার দেড় লাখ পিস লবণযুক্ত চামড়া সংগ্রহ করবেন। তাঁদের হিসাবে, প্রতি পিসে ৩০-৫০ টাকা বেশি লেগেছে।
ঢাকার বাইরেও চামড়ার দাম কম। চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী জানান, গত বছর ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা লোকসান দেয়ায় এবার কম চামড়া কিনেছেন। তিনি জানান, আড়তদারেরা ৩০০-৩৫০ টাকায় কিনতে চাইছেন।
এক আড়তদার নেতা জানিয়েছেন, লবণ ছাড়া চামড়া বেশি দামে কেনা সম্ভব নয় এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বিষয়টি বুঝে নিতে হবে। তাঁর দাবি, এবার ৬০০-৭০০ টাকাও দাম উঠেছে।
২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প সরিয়ে পরিবেশবান্ধব নগর গড়ার প্রকল্প নেওয়া হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। হেমায়েতপুরে সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে।
চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দূষণ রোধ না করায় ইউরোপ-আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। ফলে প্রধান ক্রেতা এখন চীন, যারা কম দাম দেয়।
এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেন, একসঙ্গে প্রচুর চামড়া আসায় ও সংরক্ষণের অভাবে দাম কমে যায়। হেমায়েতপুরের শিল্প নগর পরিবেশবান্ধব করা গেলে বছরে ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি সম্ভব, আর তাতে কোরবানির চামড়ার দাম স্বাভাবিকভাবেই বাড়ত। তাই নগরটিকে কমপ্লায়েন্ট করতেই হবে।