ঢাকার হাতিরঝিলে যৌথবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে সন্দেহভাজনদের গাড়ি ও মোটরসাইকেল থামিয়ে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। এ সময় হেলমেট না থাকায় মোটরসাইকেলে আসা দুই তরুণীকেও থামান দায়িত্বরতরা। ট্রাফিক আইন ভাঙার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এই ঘটনাটি সাংবাদিকরা ভিডিও ধারণ করতে থাকেন।
দুই তরুণী বারবার হাতজোড় করে ভিডিও না করার অনুরোধ করলেও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল না। তাদের একজন মুখ আড়াল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং কিছুটা দূরে সরার চেষ্টা করলেও সাংবাদিকরা তাদের পিছু নেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, ‘এত রাতে কেন বাইরে?’
এই ভিডিওগুলো সংবাদমাধ্যম ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা শুরু হয়। প্রশ্ন ওঠে, কেবল ট্রাফিক আইন ভাঙার দায়ে কারও সম্মতি ছাড়াই ভিডিও প্রচার করা কতটা ন্যায়সংগত?
বিভিন্ন এলাকায় রাতের তল্লাশি চৌকির ভিডিওতেও দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিগত ব্যাগ বা গাড়িতে থাকা জিনিসপত্র প্রকাশ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদের ‘ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর’ উত্তরও প্রচারিত হচ্ছে।
এ ধরনের ঘটনার সমালোচনা করেছেন সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টরাই। তাদের মতে, এই ‘মোরাল পুলিশিং’ এবং ‘ভিউ বাণিজ্যের’ প্রবণতা সাংবাদিকতার মূলধারা থেকে বিচ্যুতি। প্রশ্ন উঠেছে, এমন প্রচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি আদৌ আস্থা অর্জন করছে?
১৩ জুন রাতের ওই ঘটনায় একটি ভিডিওর শিরোনামে লেখা হয়, ‘গভীর রাতে হেলমেটবিহীন দুই নারী, চড়াও হলেন সাংবাদিকদের উপর।’ যেখানে একজন তরুণীকে বলতে শোনা যায়, “গালি দেই নাই ভাইয়া, আমি বলছি বাসায় প্রবলেম হবে, আপনারা এইগুলা দিয়া ভিডিও করতেছেন… আমরা মেয়ে মানুষ, আমাদের বাসায় সমস্যা হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “হেলমেট না পরা ট্রাফিক আইনের ব্যত্যয়। শাস্তি হওয়া উচিত আইনি প্রক্রিয়ায়। কিন্তু তাদের সম্মানহানি ঘটলে তারা ভুক্তভোগী। চাইলে ভিডিও প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, “সাংবাদিকদের কাজের পরিধি ও পদ্ধতি রয়েছে। এভাবে কারও সম্মানহানি করা সাংবাদিকতার মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে।”
তল্লাশির সময় সাংবাদিকদের উপস্থিতির বিষয়ে জানা যায়, এসব অভিযান পরিচালনার খবর অভ্যন্তরীণ সাংবাদিক গ্রুপে ছড়িয়ে পড়ে, যা কখনো আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণের মাধ্যমেও ঘটে। ফলে মূলধারার সাংবাদিক ছাড়াও ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতারাও উপস্থিত থাকেন।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা সচেতনতা বাড়াতে কিছু সময় মিডিয়া কভারেজ চায়। তবে প্রচারের পদ্ধতি সাংবাদিকদের নিজস্ব নীতিমালার বিষয়।
২০১২ ও ২০১৯ সালে হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণে গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজনদের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানার নির্দেশ রয়েছে। যেখানে অভিযুক্তদেরও গণমাধ্যমে দেখানো উচিত নয়, সেখানে সড়কে ট্রাফিক আইন ভাঙার মতো ঘটনায় ভিডিও প্রচার কতটা যৌক্তিক, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৯৯ ও ৫০৫ ধারায় মানহানি ও আতঙ্ক সৃষ্টির বিধান রয়েছে।
সাংবাদিক রাফসান জানি বলেন, “এই ধরনের সাংবাদিকতায় সচেতনতা নয়, সেনসেশন তৈরির প্রবণতা বেশি। মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে কাউকে সামাজিকভাবে শাস্তি দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।”
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব ছিল নারী হেনস্তা না হয়, তা নিশ্চিত করা। তারা সেই দায়িত্ব পালন না করে ব্যর্থ হয়েছেন।”
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, “গোপনীয়তা যেন ক্ষুণ্ন না হয়, এ বিষয়ে আমরা অবশ্যই সতর্ক থাকব।”