অ্যাননটেক্সের ২৯৭ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির মামলায় আবুল বারকাত কারাগারে

অ্যাননটেক্সের ২৯৭ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির মামলায় অর্থনীতিবিদ এবং জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারকাতকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
দুদকের আবেদনে ঢাকার মহানগর হাকিম মো. জুয়েল রানা শুক্রবার এই আদেশ দেন।

শুক্রবার দুপুরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ বারকাতকে আদালতে হাজির করেন। দুপুর আড়াইটার দিকে তাকে হাজির করে হাজতখানায় রাখা হয়। পরে ২টা ৫০ মিনিটে এজলাসে তোলা হয় এবং আদালতের বেঞ্চে বসানো হয়। এ সময় মেয়েসহ স্বজনরা পাশে ছিলেন, মাঝে মধ্যে নাতিকে কোলে নেন বারকাত এবং অন্যদের সঙ্গে কথা বলেন।

৩টা ৩৫ মিনিটে আদালতের বিচারকাজ শুরু হয়। দুদকের প্রসিকিউটর রেজাউল করিম আদালতকে জানান, “২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা। তদন্ত কর্মকর্তা তার তিন দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছেন। তার রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।”

বারকাতের পক্ষে আইনজীবী আব্দুল আউয়াল রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিন আবেদন করেন। তিনি বলেন, “তিনি (বারকাত) বয়স্ক, অসুস্থ একজন মানুষ। শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। আর যে বিষয়ে মামলা সেটা ২০২২ সালেই সেটলমেন্ট হয়ে গেছে। এ বছর আবার সেই বিষয়ে এসে মামলা। রিমান্ড বাতিলের প্রার্থনা করছি। প্রয়োজনে তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।”

এ সময় তিনি বারকাতের ডিভিশন চেয়ে আবেদনও করেন।

দুদকের প্রসিকিউটর তখন আদালতকে জানান, এ ধরনের মামলায় জামিন বা রিমান্ড শুনানির এখতিয়ার এই আদালতের নেই, মেট্রো সেশন স্পেশাল জজ কোর্টে এই বিষয়ে সেবা হতে পারে।

বিচারক জানতে চান, “তাহলে এখানে আসলেন কেন?” — এর কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারেননি দুদকের আইনজীবী।

পরে আদালত আবুল বারকাতকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম আদালত স্বঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেবেন। কিন্তু যখন আদেশ দিচ্ছিলেন, তখন আদালতকে মেনশন করেছি। আদালত আসামিকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। মেট্রো সেশন স্পেশাল জজ কোর্টে পরবর্তীতে রিমান্ড এবং জামিনের বিষয়ে শুনানি হবে।”

দুদকের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, “মামলাটি অর্থ আত্মসাৎ এবং জাল-জালিয়াতির বিষয়াধীন। এরসাথে আর কারো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না তা উদঘাটন করতে আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।”

শুনানি শেষে বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে বারকাতকে হাজতখানায় নেওয়া হয়। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “আপনারা ভালো থাকবেন। আমি একজন শিক্ষক মানুষ।”

বৃহস্পতিবার রাতে ধানমণ্ডির ৩ নম্বর সড়কের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স গ্রুপের নামে ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, আবুল বারকাতসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক নাজমুল হুসাইন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, অ্যাননটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। মূলত ২০১৩-১৪ সময়কালে বড় অঙ্কের বিতরণ ঘটে, যখন আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক বারকাত প্রথম ওই দায়িত্ব পান ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার সময়ে জনতা ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন জনতা ব্যাংকের সাবেক পরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ, মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন ও পরিচালক মো. আবু তালহা; জনতা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও মহাব্যবস্থাপক (পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও) আব্দুছ ছালাম আজাদ, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক আজমুল হক, সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক অজয় কুমার ঘোষ, সাবেক ব্যবস্থাপক (শিল্প ঋণ-১) মো. গোলাম আজম, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহজাহান, এসইও মো. এমদাদুল হক, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল জব্বার, সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. গোলাম ফারুক, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক, এফসিএ মো. ইমদাদুল হক, নাগিবুল ইসলাম দীপু, আর এম দেবনাথ, মো. আবু নাসের, মিসেস সঙ্গীতা আহমেদ এবং নিতাই চন্দ্র নাথ।

এছাড়া আসামির তালিকায় আছেন অ্যাননটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউনুছ বাদল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক সহকারী পরিচালক মোছাম্মৎ ইসমত আরা বেগম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর-২ আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান।

এজাহারে বলা হয়েছে, মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড জমির মালিক হওয়ার আগেই সেই জমি নিজেদের বলে দাবি করে এবং সেখানে স্থাপনা দেখিয়ে ব্যাংকে বন্ধক রাখে। সেই জমিতে কোনো স্থাপনা বা কারখানা না থাকার পরও আসামিরা ‘পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা, মিথ্যা নথি তৈরি, জালিয়াতির’ মাধ্যমে সেই আবেদন মূল্যায়ন করেন।

৩ কোটি ৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকার জমির মূল্যায়ন করা হয় ১৬৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন, বিতরণ এবং গ্রহণের মাধ্যমে জনতা ব্যাংকের ২৯৭ কোটি ৩৮ লাখ ৮৭ হাজার ২৯৬ টাকা আসামিরা ‘আত্মসাৎ’ করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেনকে জমি ও স্থাপনার মূল্য বাড়িয়ে দেখাতে ‘সহায়তা’ করেছেন অন্য ২০ আসামি।

মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিংয়ের পরিচালক মো. আবু তালহা কোম্পানির আয়ব্যয়ের সুবিধাভোগী। তার ‘জ্ঞাতসারে’ এবং সম্মতিতে ‘মিথ্যা নথি ব্যবহার ও জালিয়াতি’ করে জনতা ব্যাংকের টাকা ‘আত্মসাৎ’ করা হয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, অবৈধভাবে ঋণ পেতে ও টাকা আত্মসাতে সহায়তা করেছেন জনতা ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তারা।

জনতা ব্যাংকের সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল জব্বার, মো. গোলাম ফারুক ও ওমর ফারুক বলেছিলেন, প্রস্তাবিত ঋণটি মঞ্জুর হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও অনুশাসন লঙ্ঘন হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি গ্রহণ সাপেক্ষে ঋণ মঞ্জুরের জন্য সুপারিশ করেছিলেন তারা।

অ্যাননটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. ইউনুছ বাদল সুপ্রভ স্পিনিংয়ের অনুকূলে মঞ্জুর করা ১৮০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের হিসাবে গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেন।

আবুল বারকাতসহ অন্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ পেতে ও আত্মসাতে সহায়তা করেছেন বলে দুদক অভিযোগ করেছে।

দুদক জানায়, ঋণ গ্রহীতা একজন ‘নাম সর্বস্ব ব্যবসায়ী’ জেনেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তারা ঋণ পেতে ও আত্মসাতে সহায়তা করেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দশম গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পান আতিউর রহমান।

এজাহারে বলা হয়, ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত থাকলেও তাদের নাম, ঠিকানাসহ তথ্য না পাওয়ায় এজাহারভুক্ত করা যায়নি। তদন্তকালে তাদের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে।