পুলিশ সংস্কারের উপযুক্ত সময় এখন: নাগরিকদের মতবিনিময়ে জোরালো দাবি

রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পেশাদার এবং জনবান্ধব পুলিশ গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। তাঁদের মতে, ১৯৩০ সাল থেকে দমনমূলক সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা পুলিশের মনস্তত্ত্বে পরিবর্তন আনার এখনই সময়। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কার্যকর পুলিশ সংস্কার।

পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনস অডিটোরিয়ামে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ: নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব আলোচনা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সব মহানগর পুলিশের কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা।

নাগরিকদের সঙ্গে পুলিশ সপ্তাহে মতবিনিময়ের এই আয়োজন ছিল নতুন চিন্তা। শিক্ষক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, লেখক, খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও শ্রমিকনেতাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষেরা এতে অংশ নেন।

সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা না থাকায় পুলিশ পেশাদার হতে পারেনি। দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন না করায় সংবিধানের অপারেশনাল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, পুলিশকে দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে এবং এই মনোভাব সহজে পরিবর্তন হয় না। অন্যায় আদেশ না মানার ক্ষেত্রে পুলিশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, পুলিশ জনপ্রিয় নয়—এটি স্বাভাবিক। তবে তাদের অবস্থান জনগণের বিপক্ষে হওয়া উচিত নয়। বিচারব্যবস্থার অকার্যকারিতাও পুলিশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম বলেন, স্বাধীনতা চাইলেও অনেকেই পদোন্নতির জন্য ‘গোলামি’ করতে চান, যা বন্ধ হওয়া উচিত। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে পদোন্নতি নিয়ে তিনি বলেন, যাদের প্রাপ্য ছিল, তাদের সেটি অবসরের আগেই দেওয়া উচিত।

আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, জনতার পুলিশ মানে শুধু পরিচয় নয়, এটি একটি দর্শন। অস্ত্র নয়, জনগণের আস্থা অর্জনই পুলিশের প্রকৃত শক্তি। জনগণের পাশে দাঁড়ানোই পুলিশের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়, তখন পুলিশ জনতার পুলিশ হতে পারে না। বিরোধী দল দমন করাকে পুলিশের কৃতিত্ব হিসেবে দেখানোর ঘটনাও অতীতে ঘটেছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান বলেন, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিলের দাবির নজির আগে ছিল, যা উদ্বেগজনক। অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, জনগণের পাশে দাঁড়ালেই পুলিশ আস্থার প্রতীক হয়ে উঠবে।

শিল্পপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, পুলিশের মধ্যে সেবার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, পুলিশকে সেবক রূপে গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য।

সভায় আরও বক্তব্য দেন সম্পাদক নূরুল কবীর, অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী এবং আইজিপি বাহারুল আলম।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়েও সভায় সমালোচনা হয়। বক্তারা বলেন, রিপোর্টে স্বাধীন কাঠামো ও রূপরেখার অভাব রয়েছে। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ও বিধির বিভিন্ন ধাপে সমস্যা রয়েছে এবং প্রকৃত সংস্কার হলে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব কমবে।

সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট এক সপ্তাহে তৈরি করা সম্ভব ছিল। কমিশনের সুপারিশে ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র কথা বলার অর্থই হলো অনিশ্চয়তা।

আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ জনগণের পাশে থাকবে, মুখোমুখি নয়। সমাপনী বক্তব্যে পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান গোলাম রসুল বলেন, জনগণের পুলিশ হওয়ার লক্ষ্যেই তারা কাজ করছেন।

উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেওয়া নাগরিকরা বলেন, পুলিশ যেন নিরীহ মানুষের ওপর গুলি না করে, প্রকৃত অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং মিথ্যা মামলায় কাউকে হয়রানি না করে। পুলিশের কাছে যেন সব শ্রেণির মানুষ নির্ভয়ে যেতে পারে এবং তারা যেন অপরাধীর জন্য আতঙ্ক আর সাধারণ মানুষের জন্য ভরসা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *