জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত ‘৩৬ জুলাই: আমরা থামবো না’ শীর্ষক কর্মসূচির অংশ হিসেবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত নেতাদের ছবির প্রদর্শনী করেছে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির, যা অনেকের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে জামায়াতে ইসলামী আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, শুরা সদস্য মীর কাসেম আলী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছবি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তারা সবাই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন। এর মধ্যে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত সাঈদী কারাগারে মারা যান। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাকি ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের দণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও, ২০১৪ সালে কারাগারে তার মৃত্যু হয়। তার ছবি এই প্রদর্শনীতে রাখা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে মঙ্গলবার সকালে টিএসসির ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে এই কর্মসূচির সূচনা হয়। সেখানেই প্রদর্শিত হচ্ছে এসব ছবি। ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করে আসা জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের দাবি, তাদের এই নেতারা আওয়ামী লীগের আমলে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হয়েছেন।
তবে শিবিরের এমন আয়োজন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নউরিন সুলতানা তমা বলেন, “৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থান দিবস উদযাপনে চিহ্নিত গণহত্যাকারী রাজাকারদের ছবি টাঙিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করেছে শিবির। গণহত্যাকারীদের ছবি দিয়ে তারা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—গণঅভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীতার বার্তা বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে চাইছে।”
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সর্ব মিত্র বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে ছাত্রশিবির কর্তৃক টিএসসিতে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের ছবি প্রদর্শনের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। একাত্তরের রক্ত শুকিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যারা তখন ধর্ষণ ও গণহত্যা চালিয়েছে, তা ভুলে যাওয়া যায় না। একাত্তর ও চব্বিশ উভয়ই আমাদের ইতিহাসের অংশ, যারা এই দুই অধ্যায়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাজাকারদের পক্ষে বয়ান তৈরি করতে চায়, তাদের প্রতি চরম ঘৃণা।”
তিনি আরও বলেন, গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘রাজাকার’ তকমা দেওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। “যদি শিবির মনে করে তারা সেই শিক্ষার্থীদের কাছে রাজাকারদের গ্লোরিফাই ও নরমালাইজ করবে, তাহলে এটা তাদের জন্য ঘৃণাই বয়ে আনবে।”
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, “একাত্তর বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, এটাকে কোনো সংগঠন অস্বীকার করতে পারে না। তবে শেখ হাসিনার আমলে বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আমরা এটাকে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে দেখেছি। নিরপেক্ষ বিচার হলে আমরা মেনে নিতাম।”
তিন দিনব্যাপী এই আয়োজন শেষ হবে ৭ অগাস্ট। এতে জুলাইয়ের চিত্র প্রদর্শনী, জুলাই বিপ্লব নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, বিপ্লবের গান ও কবিতা, শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের গল্প, নাট ও মাইম, প্লানচেট বিতর্ক ও আলোচনা সভা থাকবে।
এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে টিএসসির সবুজ চত্বরে প্রতীকী গণভবন ‘ফতেহ গণভবন’ এবং ‘৩৬ জুলাই এক্সপ্রেস’ তৈরি করা হয়েছে। প্রদর্শনীতে দেখানো হচ্ছে জুলাইয়ের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ছবি, স্লোগান, নারী চরিত্রের বিপ্লবী চেহারা, গণভবন দখলের দৃশ্য, আবু সাইদসহ শহীদদের ছবি।