চট্টগ্রামের পুরাতন সার্কিট হাউজ মাঠকে সর্বজনীন মুক্তাঙ্গন ঘোষণার দাবি

চট্টগ্রামের পুরাতন সার্কিট হাউজ ও এর সামনের মাঠটিকে ‘সর্বজনীন নাগরিক মুক্তাঙ্গন’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম।
সোমবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানানো হয়।

ওই জমির মালিকানায় আছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তিন একর জমিতে শিশুপার্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখালে ১৯৯২ সালে ১৩ জুলাই নগর সংস্থাকে অনাপত্তি দিয়েছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

নানা ঘটনা পেরিয়ে ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর ওই জমিতে স্থাপিত ‘চট্টগ্রাম শিশু পার্ক’ সিলগালা করে জমিটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেই থেকে মাঠটি তাদের অধীনে আছে।

সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের পক্ষে স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, “১৯১৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত সার্কিট হাউজের উন্মুক্ত পরিসরটি সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি জনবান্ধব নাগরিক মুক্তাঙ্গনে পরিণত করা হোক।
“পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের দাবি, এই ঐতিহাসিক চত্বরে কোনরকম স্থাপনা নির্মাণ না করে একটা সর্বজনীন মুক্তাঙ্গন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হোক।”

চট্টগ্রাম মহানগরে জনসংখ্যার অনুপাতে উন্মুক্ত পরিসর উদ্বেগজনকভাবে সীমিত মন্তব্য করে স্থপতি জেরিনা বলেন, “চট্টগ্রামে যতটুকু উন্মুক্ত পরিসর আছে, সেটা কোনো মানদণ্ডেই পড়ে না। শহরকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে উন্মুক্ত স্থানের নেটওয়ার্ক দরকার। অথচ শহরে কোনো বড় পার্ক বা উন্মুক্ত স্থান নেই।
“১৯৬১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রণীত সবগুলো মহাপরিকল্পনায় যে উন্মুক্ত পরিসরের তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাতে এই মাঠটি ছিল। মহাপরিকল্পনাগুলোতে জনপরিসর সংরক্ষণের নির্দেশনাও দেওয়া আছে।”

জেরিনা হোসেনের ভাষ্য, ১৯৯৩ সালে নগর সংস্থার ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ সিদ্ধান্তে স্থানটিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইজারা প্রদান করা হয়। সীমানা প্রাচীর ও স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে ওই মাঠকে ঘিরে ‘সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার পরিবেশ’ ধ্বংস করা হয়।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক জেরিনা বলেন, “২০২৪ সালে জেলা প্রশাসন সেসব অপরিকল্পিত স্থাপনা উচ্ছেদ করলে নগরবাসী আশাবাদী হয়েছিল। তখন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের পক্ষ থেকেও স্থানটিকে উন্মুক্ত পরিসরে পরিণত করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
“পরবর্তীতে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়, এই প্রাঙ্গণটি জনগণের মুক্তাঙ্গন হিসেবেই রক্ষিত থাকবে। কিন্তু সম্প্রতি অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, সীমানার ভেতরে মালিকানা দাবিমূলক নির্দেশনা রয়েছে। যাতে জনসাধারণের প্রবেশাধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক নির্দেশনা রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে নাগরিক হিসেবে আমরা শঙ্কিত বোধ করছি।”

ফোরামের সভাপতি বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, “শৈশব থেকে আমরা দেখেছি এটি ছিল উন্মুক্ত জনপরিসর। সব বয়সী মানুষ মুক্তির খোঁজে এখানে আসতেন। মাঝে পার্কের নামে এটি দখলে ছিল বলে এখন আর কেউ তা দখলে রাখবে, সেটা হয় না।
“মালিকানা মানে সরকারি ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব; যা কখনো উন্মুক্ত ছিল তা কেউ বন্ধ করতে পারে না। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। এখন যারা সরকারে আছেন, তাদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টাসহ অনেকেই এই মাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে জানেন।”

অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, “সেখানে আজ ঘেরা, কাল ফটক দেওয়া হচ্ছে। এই খেলার দরকার নেই। তারা জনগণের পক্ষে থাকবেন এটাই আশা করব। এই শহরের সব জনপরিসর উন্মুক্ত করা হোক, শুরু হোক এই মাঠ দিয়ে।”

সংবাদ সম্মেলনে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব জাফর আলম বলেন, “মুক্তাঙ্গন ও জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুসারে উন্মুক্ত স্থানগুলো মহাপরিকল্পনায় চিহ্নিত। চট্টগ্রাম নগরীর যত মহাপরিকল্পনা হয়েছে সবগুলো সরকারি গেজেটেড।
“আইন অনুসারে এসব জনপরিসরের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এটা আইনত অপরাধ। এমনকি ব্যক্তি মালিকানার জমিও যদি জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত কখনো থেকে থাকে সেটাকে পরে বন্ধ করা যায় না।”

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সার্কিট হাউজের সামনেই এই মাঠে চট্টগ্রামে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৮৮ সাল থেকে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের আউটার মাঠ, জিমনেসিয়াম এবং সেসময়ের পুরাতন সার্কিট হাউজের মাঠ ঘিরে মুক্তিযু্দ্ধের বিজয় মেলা শুরু হলে শিশু পার্কের ওই স্থানটিতে প্রথম ‘বিজয় মঞ্চ’ স্থাপিত হয়েছিল।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আগ্রহে ১৯৯২ সালে ১৩ জুলাই তিন একর জমিতে শিশুপার্ক স্থাপনে নগর সংস্থাটিকে অনাপত্তি দিয়েছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
পরে ১৯৯৪ সালে ঢাকার প্রতিষ্ঠান ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস লিমিটেড’কে ২৫ বছরের জন্য জমিটি প্রথমবার ইজারা দিয়েছিল সিসিসি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ওই ইজারার মেয়াদ শেষ হয়।
এরপর ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আবার ১৫ বছরের জন্য একই প্রতিষ্ঠানের সাথে পার্কের জমিটির ইজারা চুক্তি নবায়ন করে নগর সংস্থা। তখন সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন।

বিগত সরকারের আমলে ওই জমি থেকে শিশু পার্ক অপসারণ করে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং জনপরিসর হিসেবে উন্মুক্ত রাখার দাবিতে আন্দোলন করেছিল কয়েকটি সংগঠন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশলী এবিএমএ বাসেত, স্থপতি আহমেদ জিল্লুর চৌধুরী, অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন, অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া, প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম ও পরিবেশবিদ তসলিমা মুনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *