মাইক্রোক্রেডিটকে এনজিওর সীমা ছাড়িয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং কাঠামোয় রূপান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, “মাইক্রোক্রেডিটই আগামী দিনের প্রকৃত ব্যাংকিং। টাকার ভিত্তিতে নয়, মানুষের বিশ্বাস ও পরিচয়ের ভিত্তিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।”
শনিবার (১৭ মে )রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নতুন ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, “মাইক্রোক্রেডিট এখনো এনজিও পর্যায়ে রয়ে গেছে। কিন্তু এটিকে টেকসই করতে হলে ‘ব্যাংকিং মেজাজে’ আসতে হবে। মাইক্রোক্রেডিটকে ব্যাংক হিসেবে গঠনের জন্য আলাদা আইন করতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা যখন গ্রামীণ ব্যাংক শুরু করি, তখন অনেকে আপত্তি তুলেছিল—এটাকে ব্যাংক বলা যাবে কি না। আমি বলেছিলাম, আমাদেরটাই আসল ব্যাংক, কারণ এটা চলে বিশ্বাসের ভিত্তিতে, জামানতের ভিত্তিতে নয়। আজকে যেসব ব্যাংক নিজেদের ‘প্রকৃত ব্যাংক’ বলত, তাদের অনেকে লোপাট হয়ে গেছে। অথচ মাইক্রোক্রেডিট আজও অটুট।”
নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠনের পেছনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য দেখে বহু এনজিও মাইক্রোক্রেডিট কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে অনেক অপপ্রয়োগও শুরু হয়। তখন আমি রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন বলেছিল, এটা তাদের কাজ না। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে সহায়তা নিই।”
তিনি বলেন, “তৎকালীন গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদ এই প্রস্তাবে সমর্থন জানান। কিন্তু আমরা বলেছিলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাইক্রোক্রেডিট বোঝে না। এটা যেন ইউরোপিয়ান ফুটবলের রেফারিকে দিয়ে আমেরিকান ফুটবল খেলানো—পরিণতি হবে বিপর্যয়। অবশেষে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়, যা আজ নিজস্ব ভবন পেল।”
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “বিশ্বের অনেক দেশই মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেশন নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। আমি তাদের বলেছি, বাংলাদেশ এরই মধ্যে কার্যকর মডেল দিয়েছে। এমআরএ শুধু দেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও সহায়ক ভূমিকা রাখছে।”
ব্যাংকিং খাতের পরিপূরক শক্তি মাইক্রোক্রেডিট: গভর্নর আহসান এইচ মনসুর
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “মাইক্রোক্রেডিট এখন আর ক্ষুদ্র কিছু নয়। এ খাতে ব্যাংকিং খাতের প্রায় ১০ শতাংশ সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে। সদস্যদের সঞ্চয় ৬৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৬১ হাজার কোটি টাকা।”
তিনি বলেন, “এই খাত এখন দাতাভিত্তিক নয়, আত্মনির্ভরশীল। মাত্র তিন হাজার কোটি টাকার মতো দাতা সহায়তা রয়েছে—যা খুবই সামান্য। অর্থাৎ, উপকারভোগীরা নিজেদের সঞ্চয় ও উদ্বৃত্ত দিয়েই নিজেদের গড়ে তুলছেন।”
তিনি আরও বলেন, “গ্রামীণ অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। মাইক্রোক্রেডিটের শাখা ২৬ হাজারের মতো, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শাখা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এখানে এখন একটি স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। মাইক্রোফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশনগুলোকে এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে।”
গভর্নর জানান, মাইক্রোক্রেডিটের জন্য একটি নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে এবং শিগগিরই সরকারের কাছে তা উপস্থাপন করা হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এমআরএ একসঙ্গে কাজ করে এই খাতকে আরও সুসংগঠিত ও কার্যকর করবে।
সহনশীল নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর পরামর্শ অর্থ উপদেষ্টার
অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় কড়াকড়ির বদলে ব্যবহারবান্ধব হতে হবে। আইন যেন এমন হয়, যা কোনো চাপ প্রয়োগ করে না বরং সহজতর পথ তৈরি করে। এমআরএ-কে শুধু রেগুলেশন নয়, প্রমোশনাল কার্যক্রমেও এগিয়ে আসতে হবে।”
তিনি বলেন, “সার্ভিস চার্জ ও সঞ্চয়ের রিটার্ন যেন সুবিধাজনক হয়, সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে, যাতে উপকারভোগীদের জন্য এটি সহজ ও টেকসই হয়।”
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. এম আনিসুজ্জামান চৌধুরীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।