বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা শুক্রবার টোকিওতে ঘোষণা দিয়েছেন, দুই দেশ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (ইপিএ) সম্পন্ন করবে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তাঁরা এ সিদ্ধান্ত জানান। বৈঠকে উভয় নেতা দুই দেশের সম্পর্কের বিস্তৃত পরিসর নিয়ে আলোচনা করেন এবং কৌশলগত অংশীদারত্বের প্রতি তাঁদের অটল প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রচেষ্টায় জাপান বাংলাদেশের পাশে থাকবে। অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে। তিনি আরও বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম।
ইপিএ চুক্তি বিষয়ে তিনি জানান, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই বছরের শেষ নাগাদ দুই দেশ চুক্তিটি সম্পন্ন করবে।
অর্থনৈতিক সংকট, শূন্য কোষাগার এবং বিধ্বস্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঝে জাপানের অবিচল সমর্থনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা জাপানকে কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, “আমরা জাপানকে ধন্যবাদ জানাই অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারমূলক উদ্যোগে সমর্থনের জন্য এবং ভবিষ্যতেও সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করি।”
অধ্যাপক ইউনূস একটি মুক্ত, উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “সমুদ্র নিরাপত্তা, চলাচলের স্বাধীনতা, সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, কানেক্টিভিটি জোরদার এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ দমন—এসব খাতে বাংলাদেশ জাপানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে প্রস্তুত।”
তিনি ইপিএ আলোচনা এবং সাম্প্রতিক উচ্চ পর্যায়ের সফরে অর্জিত অগ্রগতির কথা তুলে ধরেন। দীর্ঘমেয়াদে জাপানের সঙ্গে গভীর সম্পৃক্ততার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে আগ্রহী।’
অধ্যাপক ইউনূস মাতারবাড়িতে ভূমি-ভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল, মহেশখালিতে আমদানি-নির্ভর এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ এবং ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পর তিন বছরের জন্য শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় রাখতে জাপানের সমর্থন কামনা করেন।
তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উন্নয়ন এবং মেঘনা-গোমতী নদীর ওপর নতুন চার লেনের সেতু নির্মাণের জন্য সফট লোন চেয়ে আহ্বান জানান।
এছাড়া জাপানি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে অটোমোবাইল, বৈদ্যুতিক যান, হালকা যন্ত্রপাতি, উচ্চ প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক্স এবং সৌরশক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, শিল্প মূল্য শৃঙ্খলে সংযুক্ত হতে বাংলাদেশ প্রস্তুত।
বাংলাদেশ-জাপান দক্ষ শ্রমিক অংশীদারিত্ব কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে জাপানের শ্রম সংকট মোকাবেলা এবং বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির অনুরোধও জানান অধ্যাপক ইউনূস। পাশাপাশি, শিক্ষার্থী এবং কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ ইনস্ট্রাক্টরদের জন্য জাপানে পড়াশোনার সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানান।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে একটি সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টায় টোকিও সহায়তা অব্যাহত রাখবে।
বৈঠকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক বিষয়েও আলোচনা হয়। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তাঁর সরকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সর্বোত্তম সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে জাপানের প্রচেষ্টা আরও বাড়ানোর আহ্বানও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী ইশিবা ৩৮ বছর আগে বাংলাদেশ সফরের স্মৃতিচারণ করেন, যখন যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণে জাপানের সহায়তা ছিল। তিনি অধ্যাপক ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, “জাপানি জনগণ আপনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে।”
তিনি পারস্পরিক সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেন।