গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পর: সংকটে গণতন্ত্রের পথচলা

শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটানো গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহের এই আন্দোলনে এক হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান; আহত হন আরও অনেকে। শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।

নতুন সরকার শৃঙ্খলা ফেরানো ও ক্ষতিগ্রস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে ১১ মাস পর পরিস্থিতি কঠিনই দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা কমেনি; রাজনৈতিক নেতারা এখনও গঠনমূলক আলোচনার চেয়ে পরস্পরকে আক্রমণে বেশি ব্যস্ত। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক ও সাহায্য কমানোর সিদ্ধান্ত দেশের উন্নয়নকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কও এখন সংকটে।

অধ্যাপক ইউনূস অবশ্য বলছেন, তাঁর পরিকল্পনা সঠিক পথে এগোচ্ছে। সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবে।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে ৩.৯ শতাংশ হতে পারে, তবে এটি আগের আশঙ্কার চেয়ে ভালো। প্রবাসী আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে এবং মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ থেকে নেমে ৯ শতাংশে এসেছে। সরকার খেলাপি ঋণ কমাতে এবং পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে।

এই উন্নতির প্রেক্ষাপটে আইএমএফ ও এডিবি বাংলাদেশকে নতুন ঋণ অনুমোদন করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংস্কার অনেকটাই এখনো সহজ স্তরে সীমাবদ্ধ।

বাংলাদেশ এখনো পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। দুর্বল অবকাঠামো ও কর্মসংস্থান ঘাটতি উদ্বেগের কারণ। যুক্তরাষ্ট্র নতুন শুল্ক আরোপ করায় এসব সমস্যার সমাধান জরুরি হয়ে উঠেছে।

পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইউনূস ‘সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক’ চাইলেও, চীন সফরে গিয়ে কিছু চুক্তি করেন। বাংলাদেশ জে১০সি ও জেএফ১৭ যুদ্ধবিমান কেনার কথা ভাবছে—যা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনও হয়েছে। এতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরেছে—যে দেশ এক সময় ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল এবং বর্তমানে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে।

বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারতের প্রতি আগ্রহ কমেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ চীনকে পছন্দ করে, আর ভারতকে পছন্দ করে মাত্র ১১ শতাংশ।

এপ্রিলে ভারত বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে, যার ফলে রপ্তানির খরচ বেড়েছে। চীনের দিকে ঝুঁকে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ছিল রোহিঙ্গা সহায়তাসহ নানা খাতে প্রধান দাতা। এখনো যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা।

বর্তমানে মূল প্রশ্ন হলো—গণতন্ত্র কত দ্রুত ফিরবে এবং তা কতটা স্থায়ী হবে। ইউনূস জানান, নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলের মধ্যে হতে পারে। তিনি চান, সব রাজনৈতিক দল ‘জুলাই সনদ’ নামে একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করুক, যাতে নির্বাচনের নিয়ম ও সরকারের সংস্কারের রূপরেখা থাকবে। তবে সনদের বিস্তারিত এখনো স্পষ্ট নয়।

এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে আছে নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে আগ্রহী হলেও, ছোট দলগুলোর ভোটপ্রাপ্তি নিয়ে সংশয় আছে। এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৫ শতাংশ ভোটার এনসিপিকে সমর্থন করছেন। বিএনপি পেয়েছে ৪২ শতাংশ এবং জামায়াতে ইসলামী ৩২ শতাংশ। উদারপন্থীদের শঙ্কা, জামায়াত ক্ষমতায় এলে ধর্মীয় চরমপন্থা বাড়তে পারে, আর বিএনপিকে দুর্নীতিপরায়ণ ভাবা হয়।

আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। মে মাসে ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ কারণে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তবে এই নিষেধাজ্ঞা আদালতের রায়সাপেক্ষ এবং স্থায়ী নয় বলে জানানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা দাবি করছে, এই নিষেধাজ্ঞা তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিচ্ছে। দলটি এখনো উল্লেখযোগ্য সমর্থন ধরে রেখেছে; এক জরিপে ১৪ শতাংশ ভোটার তাদের সমর্থন করছেন, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, দেশের অর্ধেক জনগণ এখনো দলের প্রতি সহানুভূতিশীল।

দলটির দাবি, অভ্যুত্থানের পর তাদের ২৪ জন নেতা-কর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করেছে, এখন আওয়ামী সমর্থকদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হচ্ছে—যেমনটা আগের সরকারের সময় বিরোধীদের ওপর হতো।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের আইনের অধ্যাপক আরাফাত খান মনে করেন, স্থায়ী পরিবর্তনের জন্য প্রতিশোধ নয়, জাতীয় ঐক্য গড়ার নীতিই দরকার। তাঁর মতে, বাংলাদেশের এখন দরকার একটি ‘নেলসন ম্যান্ডেলা মুহূর্ত’।