সামিরের (ছদ্মনাম) বয়স যখন কেবল ১৭, সেসময় আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে যান। নানা দেশ ঘুরে তিনি থিতু হতে পেরেছেন যুক্তরাজ্যে, ২০২৪ সালে। তালেবান কাবুল দখল করার আগে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি সরকারের জন্য কাজ করছিলেন সামিরের বাবা।
২০২১ সালের ১৫ অগাস্ট তালেবান কাবুল দখল করলে তাদের পরিবার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এখন মার্শাল আর্ট চর্চা করছেন সামির। বছর চারেক আগে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয় তাদের। তখন থেকেই শুরু হয় শিশু সামিরের শরণার্থী জীবন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বে ৪ কোটি ১০ লাখ শরণার্থীর মধ্যে শিশু শরণার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩৩ লাখ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ শরণার্থীর মধ্যে ৩৩ জনই শিশু, যাদের প্রত্যেকেরই দরকার আন্তর্জাতিক সুরক্ষা। ১৯৫১ সালে বিশ্বে শরণার্থী ছিল ২১ লাখ, যা এখন ২০ গুণ বেড়েছে। তখন প্রতি ১১৯০ জনে একজন শরণার্থী ছিল, এখন প্রতি ১৮৫ জনে একজন।
আফগানিস্তান, ইরাকের যুদ্ধ এবং সিরিয়া ও দক্ষিণ সুদানের গৃহযুদ্ধ বিশ্বে শরণার্থী বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
ছেলেমেয়ের চিত্র
২০২৪ সালের হিসাবে, মোট শিশু শরণার্থীর মধ্যে ৫১ শতাংশ ছেলে (৬ কোটি ৮০ লাখ) ও ৪৯ শতাংশ মেয়ে (৬ কোটি ৫০ লাখ)। সংখ্যায় ব্যবধান না থাকলেও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার চিত্র আলাদা। মেয়েরা বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হন, আর ছেলেরা শারীরিক সহিংসতায় আক্রান্ত হন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শরণার্থী শিশুরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার। সামিরের পরিবার সীমান্তে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশের পুলিশ আমাদের থামিয়েছে, অন্যদের সামনে মারধর করেছে। বয়সে বড় না ছোট, কেউ তোয়াক্কা করেনি।”
দীর্ঘ পথ ঘুরে গন্তব্যে
আফগানিস্তান থেকে যাত্রা শুরুর পর যুক্তরাজ্যে পৌঁছাতে দেড় বছর লেগেছে সামিরের। এ সময়ে তিনি ২ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দেন। বিশ্বের শিশু শরণার্থীর ১২ শতাংশ এভাবে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জনই ৫০০ কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করে। তাদের অর্ধেক ৫০০ থেকে ১ হাজার কিলোমিটার হাঁটেন বা ধীরগতির যানবাহনে চলেন। ঠান্ডার মধ্যে জঙ্গল ও পাহাড়ি এলাকা পেরিয়ে সামিরদের পথ চলতে হয়েছে। তুরস্ক ও বুলগেরিয়ায় সীমান্ত পুলিশের নির্মমতার কথাও জানান তিনি। “পুলিশ আমাদের মারধর করত, খোঁচা দিত, আবার আগের দেশে পাঠিয়ে দিত।”
৫ বছরের নিচে এক-চতুর্থাংশ
২০২৪ সালে শিশু শরণার্থীদের মধ্যে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সের ৪৪ শতাংশ (৫৯ লাখ), ১২ থেকে ১৭ বছরের ৩২ শতাংশ (৪২ লাখ) এবং ০ থেকে ৪ বছরের ২৪ শতাংশ (৩২ লাখ)। ছোট শিশুদের অপুষ্টি, রোগবালাই এবং শিক্ষাবিচ্যুতি সবচেয়ে বেশি। বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক আঘাতের প্রভাবও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
শরণার্থী সবচেয়ে বেশি যে দেশের
২০২৪ সালে সর্বাধিক শিশু শরণার্থী হয়েছে আফগানিস্তান থেকে—১০০ শিশুর মধ্যে ২১ জন। এরপর সিরিয়া ২০ শতাংশ, ভেনেজুয়েলা ১৪ শতাংশ ও দক্ষিণ সুদান ১০ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি আশ্রয়দাতা দেশ
২০২৪ সালে ইরান ১৮ লাখ, তুরস্ক ১৪ লাখ এবং উগান্ডা ৯ লাখ ৬৫ হাজার শরণার্থী আশ্রয় দেয়। সামির প্রথমে সমুদ্র চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে নৌযানডুবির শিকার হন। ফ্রান্সের পুলিশ তাদের উদ্ধার করে, পরে আরেকটি নৌকায় যুক্তরাজ্যে পৌঁছান। পুরো ভ্রমণে তার লেগেছে ১৮ মাস। যুক্তরাজ্যে পৌঁছার পর পুলিশের সদয় আচরণ তার মনে আশার সঞ্চার করে।
নিঃসঙ্গদের সংখ্যা কত
মোট শিশু শরণার্থীর মধ্যে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩০০ জন পরিবার বা অভিভাবক থেকে বিচ্ছিন্ন। সামির বলেন, তুরস্কে তার ভাই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। “আমাকে একদিকে পাঠানো হয়, ভাইকে অন্যদিকে। এরপর আর কখনও তাকে দেখিনি।”
উদ্বেগ ও হতাশা ঘেরা জীবন
সামির বলেন, শরণার্থী জীবনের স্মৃতি এখনও তাকে ব্যথিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু শরণার্থীদের ২৩ শতাংশ ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’, ১৬ শতাংশ বিষণ্নতা এবং ১৪ শতাংশ হতাশায় ভোগে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের সমস্যা মুখে না বললেও আচরণে ফুটে ওঠে, যা আরও গভীর সংকেত বহন করে।