শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ

চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান দমন প্রক্রিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। রোববার দুপুরে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে অভিযোগপত্র ও সংযুক্ত দলিলাদি জমা দেওয়া হয়।

১৩৪ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন। অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

প্রসিকিউশন জানিয়েছে, এই বিচারকাজ বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। আদালত অভিযোগ আমলে নিলে এটি হবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া—যা শুরু হচ্ছে সেই ট্রাইব্যুনালেই, যা গঠিত হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য।

শেখ হাসিনার পাশাপাশি মামলার আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং সেই সময়কার আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। তদন্ত শেষে গত ১২ মে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে শেখ হাসিনাকে ওই দমন-পীড়নের ‘মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, তদন্ত কর্মকর্তা ৬ মাস ২৮ দিনের মধ্যে ঘটনার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর হাতে ঘটেছে হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, গুলি করে আহত করা এবং লাশ পুড়িয়ে দেওয়া—যার নির্দেশক ছিলেন শেখ হাসিনা।

প্রতিবেদনের প্রথম অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য ও প্ররোচনার কথা বলা হয়েছে। ১৪ জুলাই তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে আখ্যা দেন, যার পরপরই রাষ্ট্রীয় ও দলীয় বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করে।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, এসব অপরাধ সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে সংঘটিত হয়। তদন্ত সংস্থা তার একাধিক টেলিফোন কথোপকথন জব্দ করেছে, যেখানে তিনি হেলিকপ্টার, ড্রোন ও এপিসি ব্যবহারের মাধ্যমে সশস্ত্র আক্রমণের নির্দেশ দেন।

অন্য তিনটি অভিযোগ নির্দিষ্ট ঘটনার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে। তাজুল ইসলাম জানান, আন্দোলন দমনে প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত, ২৫ হাজারের বেশি আহত, নারীদের ওপর সহিংসতা, শিশু হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। আহতদের চিকিৎসা এবং পোস্টমর্টেমেও বাধা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, কিছু সরকারি স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে আন্দোলনকারীদের দায় দেওয়ার চেষ্টার প্রমাণও পাওয়া গেছে। যদিও এসব ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত না করে আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

২০১০ সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বিচারের উদ্দেশ্যে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়, যার পর থেকেই তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।

আওয়ামী লীগের দলীয় ভূমিকাও বিচারাধীন করার লক্ষ্যে আইন সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ কয়েকটি দল বিচার শেষ করার দাবি জানিয়ে আসছে। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলও আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই বিচার অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই শেষ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *