সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনে অনুদান দিয়ে প্রাণ গোপাল দত্ত কুমিল্লা-৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ‘নিশ্চিত’ করেছিলেন বলে দুদকের একটি মামলার এজাহারে বলা হয়েছে।
২০২১ সালের এই উপনির্বাচন প্রাণ গোপাল এ আসন থেকে বিনাভোটে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সূচনা ফাউন্ডেশন নামে একটি ‘ভুয়া’ প্রতিষ্ঠান গড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দানের নামে ঘুষ আদায় এবং তা আত্মসাত করার অভিযোগে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছে দুদক।
মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের সম্বনিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এ মামলাটি দায়ের করেন সংস্থার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম। মামলা দায়েরের তথ্য দিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম। তার আগে সোমবার মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন।
দুদকের অনুসন্ধানের বরাতে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সূচনা ফাউন্ডেশন ১৪টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে থেকে কথিত অনুদানের নামে ১৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা গ্রহণ করেছে। তাদের একজন প্রাণ গোপাল।
এজাহারে বলা হয়, “ব্যক্তি পর্যায়ে ঘুষ প্রদানকারীদের মধ্যে অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ২০২১ সালে কুমিল্লা-৭ আসন হতে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগ এর মনোনয়ন প্রাপ্তির জন্য ওই অর্থ সূচনা ফাউন্ডেশনকে ঘুষ ও অবৈধ পারিতোষিক হিসেবে দিয়েছেন।”
গত বছরের ৫ অগাস্টের পর সূচনা ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করে।
এ বছর ২৯ জানুয়ারি দুদক ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে অভিযান চালায় এবং প্রতিষ্ঠানটি ‘অস্তিত্বহীন’ বলে জানায়। মামলার এজাহারেও দুদক বলেছে, সরেজমিন পরিদর্শনে ফাউন্ডেশনের কোনো ‘অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি’। স্থানীয় লোকজনকেও জিজ্ঞাসাবাদে ‘জানা যায়নি’ যে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পূর্বে কখনও চলমান ছিল।
অনুসন্ধানের বরাতে সংস্থাটি বলছে, পুতুলসহ অন্য আসামিরা সূচনা ফাউন্ডেশন নামক ‘কাগুজে প্রতিষ্ঠান’ গঠন করে এনজিও ব্যুরো ও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেন। এরপর তারা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দিয়ে অনুদানের নামে ‘ঘুষ আদায় করেন এবং সেই টাকা প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্যয় না করে আত্মসাৎ’ করেন।
দুদকের অভিযোগ, আসামিরা সূচনা ফাউন্ডেশনকে দেওয়া অর্থ এবং তার ব্যাংক হিসাবে থাকা অর্থ ‘অবৈধভাবে করমুক্তির সুবিধা নিয়ে আত্মসাৎ’ করেছেন। তারা পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৪৪৭ কোটি ৯৫ লাখ ৩০ হাজার ১৯৩ টাকা ‘আত্মসাৎ’ করেন। এছাড়া ২০১৫-১৬ করবর্ষ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত মোট ৯৯ লাখ ৪ হাজার ৫৩১ টাকা কর জমা না দিয়ে তারা ‘প্রতারণা’ করেছেন বলে দুদক অভিযোগ করেছে।
সংস্থাটি বলেছে, সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে খোলা ১৪টি ব্যাংক হিসাবে ৯৩০ কোটি ৯৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৯ টাকার ‘সন্দেহজনক’ লেনদেন পাওয়া গেছে।
সূচনা ফাউন্ডেশনের আসামি ১১ জন
মামলায় ফাউন্ডেশনের ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- ট্রাস্টি সায়মা ওয়াজেদ, মাজহারুল মান্নান, সাবেক বিসিবি সভাপতি ও এমপি নাজমুল হাসান পাপন, সায়ফুল্লাহ আবদুল্লাহ সোলেনখী, মো. শামসুজ্জামান, জ্যান বারী রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান প্রাণ গোপাল দত্ত, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য এম এস মেহরাজ জাহান, রুহুল হক, শিরিন জামান মুনির এবং ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ।
ব্যবসায়ী আছেন আটজন
হামিদ রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান ইন্তেকাবুল হামিদ, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম, বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি সালমান এফ রহমান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আজিজ খান, সাবেক এমপি এ কে এম রহমাতুল্লাহ, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দীন হাসান রশিদ, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এবং বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও এমডি এনায়েতুর রহমানও রয়েছেন আসামির তালিকায়।
এনবিআরের ১৬ জন
মামলায় আসামি করা হয়েছে এনবিআরের সাবেক ও বর্তমান ১৬ কর্মকর্তাকে। তারা হলেন- সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান, সদস্য মীর মুস্তাক আলী, চৌধুরী আমির হোসেন, পারভেজ ইকবাল, মো. ফরিদ উদ্দিন, মো. ফিরোজ শাহ আলম, জাহাঙ্গীর হোসেন, ড. মাহবুবুর রহমান, মো. লোকমান চৌধুরী, মো. রেজাউল হাসান, মো. জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, আব্দুর রাজ্জাক, এ এফ এম শাহরিয়ার মোল্লা (আবু ফয়সাল মো. শাহরিয়ার মোল্লা), সুলতান মো. ইকবাল, তন্দ্রা সিকদার ও কালীপদ হালদার।
এর আগে ২০ মার্চ দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সূচনা ফাউন্ডেশনের জন্য ৩৩ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহের অভিযোগে একটি মামলা করে দুদক। একই দিনে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ লাভের অভিযোগে পুতুলের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করে দুদক। এর আগে ১২ জানুয়ারি করা তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুতুলের নামে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের অভিযোগে একটি মামলা করে দুদক। ওই মামলায় পুতুল, শেখ হাসিনাসহ মোট ১৬ জনকে আসামি করা হয়। ক্ষমতায় পালাবদলের পর ওই মামলায় পুতুলকে প্রথম আসামি করা হয়।
স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৪ সালে গড়ে ওঠা সূচনা ফাউন্ডেশন মানসিক ও স্নায়বিক প্রতিবন্ধিতা, অটিজম এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করে। এ বছর ১২ জুলাই পুতুলকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আঞ্চলিক পরিচালকের পদ থেকে ‘অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে’ পাঠানোর খবর দেয় স্বাস্থ্য খাতের সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক— হেলথ পলিসি ওয়াচ।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ভারতের নয়াদিল্লিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কমিটির ৭৬তম অধিবেশনে সংস্থাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক নির্বাচিত হন পুতুল। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে এ দায়িত্ব নেন। হেলথ পলিসি ওয়াচ বলেছে, আঞ্চলিক পরিচালকের এ পদ থেকে পুতুলকে ১১ জুলাই (শুক্রবার) ‘অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠানো’ হয়।